হেলাম্বু উপত্যকা পার হতে গিয়ে




        আমার মোবাইলে যখন শ্বশুরবাড়ি থেকে ফোন আসে স্ক্রীনে ভেসে ওঠে ‘ঘোলা’ব্যাপারটা দ্ব্যার্থক সন্দেহ নেই তবে আপাতত স্থাননাম অর্থে ধরলেই হবে। কিন্তু আসল কথা সেটা নয়, সেই একই জায়গা থেকে যখন আমার স্ত্রীর ফোনে ফোন আসে তখন তার স্ক্রীনে ভেসে ওঠে ‘বাড়ি’। একই ঠিকানা মানুষ ভেদে ‘বাড়ি’ ও ‘ঘোলা’ হয়ে যায়। আবার যা আমার বাড়ি কখনো কখনো তা আর বাড়ি থাকে না। বাড়ির স্নেহস্পর্শ, তার টান ছিন্ন হয়ে যায় কিন্তু নতুন করে কোনো বাড়ির অনুভূতিও গড়ে ওঠেনা। এমন মানুষ আমরা হয়ত হামেশাই দেখিনা। আর দেখিনা বলেই সেই রাতটা আমাদের কাছে এখনো উজ্জ্বল। পূর্ণিমা্র বেশি দেরী নেই। চাঁদের গর্ভ স্ফীত। জানালার ফাঁক দিয়ে আসন্নপ্রসবা সেই চাঁদের দিকে তাকিয়ে কিশোরী তাশি দেলেক বলল ‘আমি এখান থেকে চলে যাব। আমার পশ্চিমা বন্ধু আমাকে ই-মেল করবেতার দেশে উঁচু বাড়ি, চকচক করে জানালা, সে জানালা কাঁচে ঢাকা, এমনকি এত উঁচু সে কাঁচ তাতে চাঁদও ঢাকা পড়ে যায়। আমার বাবা এখন নেই, তিব্বতে গেছে ইয়াক ধরতে। কবে ফিরবে তার ঠিক নেই। এ কি কোনো মানুষের জীবন? তিব্বতে বিশাল প্রান্তর, সেখানে কোথাও আছে বুনো ইয়াক, তাকে ধরে বেঁধে আনো, পোষ মানাও। এদিকে আমার স্কুলের ছুটি শেষ হয়ে আসছে। আচ্ছা আমার সেই বিদেশী বন্ধু আমায় মেল করবে তো? সে তো বলেছে আমাকে তার দেশে নিয়ে যাবে, আমার যাবতীয় পড়ার খরচ তার’ এর কিইবা উত্তর হয়? তাশি দেলেক তার পোশাকের ঘের দিয়ে পা দুটোকে ঢেকে নিল। ঘরের চারিদিক আঁটোসাঁটো করে বন্ধ জানালার কাচে হিম। কুপির আলো দপদপ করছে। তাশির বোন বলল আমারও যাওয়ার ইচ্ছা, কিন্তু আমি ভালো অঙ্ক জানি না। আচ্ছা কি করলে অঙ্কে ভালো হওয়া যায়? তার ওপর দিদি যতটা পারবে আমি কি ততটা পারবো? এই দেখো আমার একটা হাত নেই। তাশির বোন সোয়েটারের হাতা থেকে হাত বার করে, সেখানে শূন্যতা। কি করে বলি আমরাও তো যেতে পারিনি যেখানে যাওয়া উচিত ছিল। ল্যাংট্যাং গ্রাম পেরোতে পেরোতে হয়ে গেল বিকেল। একটু চড়াই পথে চলে তারপর সমতল। কিন্তু কিয়ানজিন তখনো দূরে, তাই এই তাশির চায়ের দোকান। খুব বুদ্ধি করে বানিয়েছে দোকানটা। ল্যাংট্যাং গ্রাম পেরোনোর পর মনে হবে ওই তো কিয়ানজিনকিন্তু পথ ক্রমশঃ সুদূরে বিস্তৃত হবেতখন মনে হবে একটু বসি আরকি, একটু চা খাই। ঠিক এই ইচ্ছা যখন আপনাকে কাবু করে ফেলবে ঠিক তখনই দেখবেন এই দোকান। আশেপাশে কয়েক মাইলের ভেতর কোনো বাড়ি নেই। অতএব তাশি। আমাদের বিপদ কিন্তু আরও একটু বেশি চা এর তেষ্টা শুধু নয়, দরকার রাতের আস্তানাকিয়ানজিন বহু দূর, তায় খবর পাওয়া গেছে লোক অনুপাতে সেখানে রাতের আস্তানা খুবই কম। অন্ধকারে পৌঁছালে বিপদ বাড়বে বই কমবেনা। আমাদের সামনে এখন একটাই বাড়িযে করে হোক এ বাড়িতে জায়গা নিতে হবে। যদিও দরজা হাট করে খোলা তবুও শহুরে ভদ্রতা একেবারে সাড়া না দিয়ে ঢুকতে বাধা দিচ্ছিল। এ সব ক্ষেত্রে আমাকে এগোতে হয়। বাইরের ঘর জনশূন্য। উপায় নেই। ভিতরের ঘরে একটি মেয়ে রেডিও শুনছে, যে ভাবে বুকে বালিশ দিয়ে আমরা গল্পের বই পড়ি সেই একই ভঙ্গী। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটি কমবয়সী মেয়ে। ‘এখানে কি থাকা যায়’? মেয়েটি চমকে উঠে বসল, তারপর তাকিয়ে থাকল অবাক হয়ে। আমি আবার বললাম ‘মানে রাত্রে এখানে কি’মেয়েটি বলল ‘না’‘একেবারেই কি নয়’? আবার বললাম আমি। তারপর আরো বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকার পর মেয়েটি বলল ‘হতেও পারে’। এই বলে আমাদের ঘরে বসিয়ে রেখে দুটি মেয়েই উধাও হয়ে গেল। সময় বয়ে যায়। একঘন্টা দেড়ঘন্টা। ঘর ছেড়ে বেরোনোও যায়না। ঘরে চাবি না দিয়ে আমাদের বসিয়ে রেখে গেল, এখন ফিরে এসে যদি বলে ‘রাস্তা দেখ’ তবে? আরো সময় যায়। চা মাথায় ওঠে। আরো কিছু পরে এক মধ্যবয়স্কা মহিলাকে নিয়ে ঘরে ঢোকে মেয়েদুটি। ‘ এ আমাদের মাসিতোমাদের আগে কেউ তো থাকেনি এখানে, একা আমরা কি করে কি করব, তাই মাসিকে নিয়ে এসেছি ল্যাংট্যাং থেকে, আর আটা, রাত্রে কিন্তু রুটি’ একটানা কথা বলে থামল তাশি। ওর নাম তাশি দেলেক। এরপর আমাদের নীরবতার পালা।
    
   নেপালে ভূমিকম্পের খবর পড়ে এই রকম নীরবতার মধ্যে কাটল ক’দিন, ল্যাংট্যাং উপত্যকায় ক্ষয়-ক্ষতি সবচেয়ে বেশি। এখন সে উপত্যকা অগম্য। যে ভ্রমণকাহিনি এতদিন লিখে ওঠা হয়নি মনে হল এইবার সেটা লিখি। আমাদের পরিকল্পনা ছিল হেলাম্বু উপত্যকা থেকে ল্যাংট্যাং উপত্যকায় যাওয়া। এই দুটো উপত্যকার মাঝে যে বিভাজিকা সেটা দুটো রাস্তা দিয়ে পার হওয়া যায়। এক তো হল গ্যানজা-লা হয়ে আরেকটা ‘সুরজকুন্ড’ পাস। আমরা দ্বিতীয়টা বেছে নিয়েছি কারন সেটা সহজ। হেলাম্বু উপত্যকা কাটমান্ডুর খুব কাছে। রক্সৌল থেকে বীরগঞ্জ ঢুকলাম ভয়ে ভয়ে। যাবার আগে রতনদা (রতনলাল বিশ্বাস)বারবার বলেছিলেন ‘ক্যামেরা কিন্তু চেকপোস্টে এন্ট্রি করিয়ে নেবে’। শেষে যাবার দিন ঘনিয়ে আসে অথচ আমার কোনো হেলদোল নেই দেখে নিজেই টাইপ করে একটা চিঠি আর ক্যামেরার বিবরণ লিখে হাতে ধরিয়ে দিলেন। সেই কাগজ নিয়ে কম্পিত বক্ষে কাস্টমস অফিসে ঢুকলামদৃঢ় বিশ্বাস ছিল ওই কাগজ দেখালে যা আমার আছে আগেই তা কেড়ে নেবে। কিন্তু ব্যাপার ঘোরালো কেউই ওই কাগজে সই করতে বা ছাপ দিতে চায়না। মহা মুশকিল। এই তো রতনদার কথার সঙ্গে পুরো মিলে যাচ্ছে। রতনদা বলেছিলেন ছাপ কেউ দিতে চায়না কিন্তু ফেরার সময় ঝামেলা করে। আমিও ভয়ে ঘ্যানঘ্যান করে চললাম। ওরাও বলে চলল ওসব ক্যামেরা-ট্যামেরা কোনো ব্যাপার নয়। ওদের কড়া নজর বড় বড় ট্রাকের দিকে। আমাদের তাড়াতে পারলে বাঁচে। এরই মধ্যে কেউ যেন ‘মুগুর আমার হাল্কা এমন মারলে তোমায় লাগবে না’ এই রকম একটা কিছু বলায় রণে ভঙ্গ দিলাম। কিন্তু সারা রাস্তায় যখনই ছবি তুলতাম মনে হত এসব বেকারফেরার সময় সবইতো ওরা কেড়ে নেবে।
  যে রিক্সা বীরগঞ্জ বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছোবে বলে আমাদের নিয়েছিল সে পথিমধ্যে নামিয়ে দিল। সেখানে বাস কিছু আছে বটে তবে মোটেই সেটা আসল বাস স্ট্যান্ড নয়। অতএব মাইলখানেক দূরে গিয়ে টিকিট কেনো। ততক্ষণে আই সি কে এন সি তে রূপান্তরিত করার কাজ শুরু হয়ে গেছে। প্রথমে একটা লোহালক্করের দোকানে ভারতীয় নোট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মালিক গুনে দিল নেপালী নোট। আসল-নকল নিয়ে কেউ ভাবিত নয়। ভারতীয় নোট নেওয়ার আগ্রহ লক্ষ করার মত। কাটমান্ডুর বাস ছাড়বে সন্ধ্যায়। বাসে ওঠার আগে সবাইকে একটা করে জলের বোতল আর ভুজিয়ার প্যাকেট দিলএই প্রথম মনে হল বিদেশে আছি। কিন্তু এ যে পীড়াদায়ক যাত্রার ক্ষতে সামান্য আগাম অ্যান্টিসেপ্টিক সেটা বুঝেছিলাম পরে। বাসে সামনের সীটে হাঁটু ঠেকে যায়। আগের লোক সীট হেলিয়ে প্রায় গায়ে শুয়ে পড়ে এবং সারারাতের যাত্রা শেষে ভোরবেলায় বাসস্ট্যান্ডে কোনো মলমুত্র ত্যাগের জায়গা নেই। এই স্ট্যান্ডের নাম কলঙ্কী। এত আসুবিধা সত্ত্বেও বাসের একটা হর্ণ আছে। প্যাঁপ্যাঁ—প্যাঁপ্যাঁ-প্যাঁআআআ। যে আওয়াজ সমস্ত কষ্ট ভুলিয়ে দিতে পারে। কিন্তু ধৈর্য ধরুন। আপাতত সুবিধা মতো বাথরুম না পেয়ে একটা ক্যাব ধরলাম। নামটা খুব ভারি। কিন্ত যানটা একেবারে লড়ঝড়ে স্কুলভ্যানের মত। তাতেই সব মাল চাপিয়ে চললাম সুন্দরীজল। কলঙ্কীতে যা নেই ৪৫ মিনিটের দূরত্বের সুন্দরীজলে তা আছে।একটা এজমালি বাথরুম। আর লম্বা লাইনের পরে মুক্তি। কিন্ত সম্পূর্ণ নয়। পোর্টার খোঁজা হয়নি। তখন এজেন্সীর চল ছিলনা। এদিকে সুন্দরীজল জনবিরল। কয়েকটা মুদি দোকান ছাড়া কিছু নেই। তার একেবারে গা ঘেঁষেই শুরু হয়েছে লম্বা গাছের ঘন জঙ্গল। হ্যাঁ, একটা খাবারের দোকান ছিল। এই মুদি দোকান থেকেই মালবাহক সংগ্রহ হল। তারা নিতান্তই মুটে। কোনো পাহাড় অভিজ্ঞ লোক নয়। এবং এরই মধ্যে একজন মাঝপথ থেকে ফিরে আসবে আগেই ঘোষণা করল। এবং এখান থেকেই শুরু হল নেপালী সিঁড়ি। অনভিজ্ঞ লোক এটা অনুভব করতে পারবেনা। মাইকেল প্যালিন সাহেব একে বলেছিলেন ‘স্লো টর্চার’। আজ এই পীড়া ১০ কিলোমিটারের। লম্বা গাছের বন। তার মধ্যে দিয়ে চলে গেছে জলের পাইপ, তারই পাশে পাশে চলা। মহিলারা কাপড় কাচছে কোথাওএসে গেল শিবপুরী ন্যাশানাল পার্ক। জনপ্রতি ২৫০ নেপালী টাকা দিতে হল। কোথাও কোথাও ঝরনা। একটা বাড়ির দাওয়ায় বসলাম। ওষুধ খেল একজন। ওর জ্বর। একজন পোর্টার নেশা করে। ও দাঁড়াচ্ছে। সারারাত বাসজার্নি করে সবাই ক্লান্ত। তার ঊপর এই সিঁড়ি। পৌঁছালাম চিসোপানি। ঠাণ্ডা জলের জায়গা। ঘর মিলল আর মিলল লেপের গরম।


 পরদিন সকালে জানালার কাচের হিম মুছে দেখি সামনে সবুজ হেলাম্বু উপত্যকা, সেখান থেকে সূর্য উঠছেকাচের রং নীল থেকে হলুদ হয়ে এল। শিশিরের ফোঁটা গড়িয়ে নামতে লাগল সোনালী রঙে রঙীন হয়ে। ঘরের বাইরে এসে দেখি ছেলেমেয়েরা ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। সামনে দশেরা। বাঁ দিকে দেখা যায় গণেশ হিমাল ও ল্যাংট্যাং হিমালের বরফে ঢাকা সারিসারি চূড়া। ওপরে গাঢ় নীল আকাশ। দৌড়ে নেমে যাই পাতিভঞ্জনের দিকে। রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে মোটরসাইকেল। আরে কাল তবে এত কষ্ট করেছি কেন? জানা গেল এই রাস্তা কাটমান্ডু যায় বটে তবে এতে চলে শুধু মোটরসাইকেল আর সরকারি জীপ। তবে ওই শব্দ কেন? প্যাঁপ্যাঁ—প্যাঁপ্যাঁ-প্যাঁআআআ, আরে এযে বাস। নাঃ খুব ভুল হয়েছে। আমাদের মধ্যে কেউ একজন কলঙ্কী বাস স্ট্যান্ডের বাসের হর্ণ নকল করেছে, সেইই মুখে আওয়াজ করে বোকা বানাচ্ছে। পাতিভঞ্জনের পরে বিশাল চড়াই। যেন দেওয়ালের ওপর ছোট্ট একটা বাড়ি দেখা যায়। চিপলিং। আর চা এর দোকান। দেখি এক সাহেব মেম বসে আছে। কোথায় যাবেন? ওদের প্রশ্ন। আমাদের উত্তর শুনে বলল বাহাদুর বটে আপনারা। তারপর একটা ম্যাপ বার করে তাতে গ্যানজা লা র উপরে আঙুল রেখে বলল এ তো খুব ঊঁচু পাস। আমরা হাসি। ওটা নয়, আমাদের পাস এইটা। এই যে সূরজকুন্ড। এতে সবাই যেতে পারে। ওরা বলল আমরাও? বললাম ‘নিশ্চই’তবে চলো আজ থেকে আমরা তোমাদের সঙ্গেবিদেশী যুবক, যুবতী মেম উঠে দাঁড়ালো। আমরা বললাম আমাদের কিন্তু তাঁবু আছে। ওরা বলল আমাদের জন্য আছে হোটেল। হাঁটা শুরু। ছোটখাটো ঘরবাড়ি। একটু ফাঁকা জায়গায় তিনটে বিশাল গাছের কাণ্ড পুঁতে তাদের মাথাগুলো এক জায়গায় এনে দড়ি দিয়ে বেঁধে সেখান থেকে ঝুলিয়েছে দোলনা। এই দোলনা খুব উঁচুতে উঠতে পারে। আর গ্রামের বালিকা থেকে যুবতী সবাই দোল খায় লাল জামা পরা একটা মেয়ে সাঁ করে নীল আকাশে উঠে আবার হলুদ মাটিতে নেমে আসছে। 


আমরাও নেমে যাই জঙ্গলের রাস্তায়, পাশে থাকে হলুদ হয়ে যাওয়া পাকা ধানের ক্ষেত। ধাপে ধাপে নেমে সে ক্ষেত চলে গেছে অনেক নিচে। সাত ঘণ্টার হাঁটা শেষে আপার গোলফুভঞ্জং। একটা বেশ সাজানো বাড়ির পেছনে সবুজ লন। সেখানে বাঁধা আছে ছোট্ট এক হরিণ। মালিক শৌখিন। আমাদের তাঁবু লাগাতে হবে ওই সবুজ ঘাসে। হরিণের থেকে একটু দূরে। তাঁবুর রং দেখে হরিণ লাফিয়ে উঠে খোঁটা উপড়ে দৌড় লাগাল। এই মাঠের নিচে আরেকটা মাঠ। সেখানে হরিণ ছুটছে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূণ্য। দড়িতে বাঁধা খোঁটার কাঠ নাচতে নাচতে চলেছে তার সঙ্গে। হরিণ আর কোথাও যায়না। ওই মাঠেই চক্কর কাটেতার সঙ্গে চক্কর কাটে তার মালিক। কিছুতেই সে ধরা দেবে না। ভয়ে যে ছুট সে লাগিয়েছিল সে ছুটই তার মুক্তির ছুট মনে হচ্ছে। মালিক ঘর্মাক্ত। এ সব দেখতে দেখতে আমাদেরও রান্নাবান্না এগিয়ে চলেছে। এবার ছিটকে লাফিয়ে উঠল আমাদের এক বন্ধু। তারপর সেও ছুটছে যেন হরিণ। তার ডান পাশে ধাপে ধাপে সবুজ মাঠ নেমে গেছে নিচে। সে দিকে সে যায়না। কিছু পরে ছটফট থামলে দেখা গেল জোঁক ধরেছে তাকেকিছুতেই থাকবেনা সে তাঁবুতে। অগত্যা ঘটিবাটি গুটিয়ে মালিকের পাকা ঘরে। গুনে দিতে হল বেশ কটি টাকা। সাহেব মেম তখন আমাদের পাশে। রাত্রে নামল অঝোরে বৃষ্টি। সকাল ৮টাতেও বৃষ্টি। ডোঙা মাথায় সেই যে শুরু, সে বিঘ্ন চলেছিল বহুদিন। আজ প্রথমে উতরাই। টিপটিপ বৃষ্টি। খালি রাস্তার দিকে চোখ। দু ধার ঝাপসা। এসে গেল গোলফুভঞ্জং। বর্ধিষ্ণু গ্রাম। চা এর আহ্বান। এড়িয়ে যাই। খুব দাম। আমি আর অমিয় এই দুইজন চলেছি একসাথে। বাকিরা অনেক পেছনে। একটা চা দুজনে খাওয়া যায়। তাও খরচা। তবে এখানে চা টা খাওয়া উচিত ছিল। সামনে বিরাট চড়াই। নেমে এসেছি বেশ নিচে। এর পর সামনের পাহাড়ে চড়তে হবে। লাগল আড়াই ঘন্টা। এখানে একটা জিনিষ ভালো আবার মন্দও বটে, সেটা হল চড়াই শেষে বা ঠিক ক্লান্তির সময়ে পাওয়া যায় চা এর দোকান, হোক না মহার্ঘ। পাওয়া যায় লেমন-টী। প্রথমে ভেবেছিলাম লেবু এরা কোথায় পায়? পরে রান্নঘরে ঢুকে দেখি গ্লাসে লেমন স্কোয়াশ দিয়ে তার পরে ফ্লাস্কে রাখা লিকার চা ঢেলে বানাচ্ছে লেবু চা। দেবে অবশ্য বড় গ্লাসে এক গ্লাস। ২০০৯ সালে দাম ছিল মনে হয় ২৫ টাকা। যা হোক সে সব খেয়ে বৃষ্টি মাথায় একটু উতরাই, তারপর আসে জঙ্গল। জঙ্গল মানে বড় উঁচু গাছের সারি। গাছের কান্ড পাতলা। ৪৫ মিনিট এভাবে চলার পর আসে চড়াই পথ। বৃষ্টিতে অবস্থা কাহিল। হঠাৎ কানে আসে প্যাঁপ্যাঁ—প্যাঁপ্যাঁ-প্যাঁআআআ। সেই বাসের নকল শব্দ। সত্যি কি জ্বালা। ঘরের গদি মোড়া সোফার কথা মনে পড়ে গেল। ধুত্তোর। কিন্তু থামার উপায় নেই। চড়াই শেষেই একটা খুব সুন্দর বাড়ি। বাড়িটা আগে থেকে কিছুতেই দেখা যাবেনা। হঠাৎ জেগে উঠবে যেখানে সেখানেই চড়াই শেষ আর বড় একটা মাঠ। বাড়িতে খুব সুন্দর সুন্দর ঘর। ধবধবে সাদা বিছানা পাতা। আর মালিকের আকুল আহ্বান। আদর করে শিকেয় তুলে রাখবে সে রাত্রিদিনতার কথায় গলে গিয়ে যখন প্রায় ঢুকে পড়েছি। জানা গেল এটা মাঙ্গিনগোট নয়। যেতে হবে আরো আধঘন্টা। অতএব গাঁটরি উঠিয়ে যেখানে গেলাম সে জায়গাও ভালো। সামনের দিকটা খোলা। সবুজ পাহাড়ের ঢাল দেখা যায় দূরে। একটা ব্যালকনি, সেখানে দাঁড়িয়ে কয়েক মূহুর্তের জন্য মেঘের ফাঁক দিয়ে ডুবন্ত সূর্যের একটু ওম গায়ে লেগে গেল। কিন্তু মিললনা সাধের রজাই। সবাই ঘর দিতে চায়, কম্বল নৈব নৈব চ। কারন অজ্ঞাত। এখানে সব হোটেলেই ডাইনিং স্পেস আছে। যত ঠান্ডাই হোক সেখানে বসেই খেতে হবে। ঘরে বসে খাবার চল একেবারেই নেই। দুনিয়ার বিদেশী ট্রেকার দের সঙ্গে এখানেই পরিচিত হওয়া আর গল্পগুজব করার সুযোগ। এখানে কিছু বেশি সময়ই কাটাতে চাই। কারন ফায়ারপ্লেস। আরেকটা জিনিস শুনেছিলাম, নেপালে থাকার ঘরের ভাড়া অতি সামান্য, কিন্তু খাবার খুব দামি। তাই ওখানে কোনো হোটেলে থাকতে দেওয়ার মূল শর্তই হল সেই হোটেলেই খাওয়া। কিন্তু যে কোনো কারনেই হোক সকলেই আমাদের রান্না করতে দিয়েছিল, ঘর ভাড়াও সে অনুপাতে বেশি কিছু নেয়নি। এখানেও আমরা কুকারে ভাত রেঁধেছিলাম আর ওই সুন্দর ব্যালকনি থেকে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে আলুসেদ্ধ করা জল আর আলুর খোসা কাঠের রেলিঙের ফাঁক দিয়ে সামনের বাগানে ছুঁড়ে ফেলেছিলাম। কেউ বকেনি। এই রকম রান্নার উপকরণ আর ভাঁজ হয়ে যাওয়া স্টোভ আগে দেখেনি বলে মালিকের ছেলে আমাদের খুব ন্যাওটা হয়ে পড়েছিল। আর এই আজব রান্না করা দেখাতে দেখাতেই ওর মা ওকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাতের ডিনারটা খাইয়ে দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু শত অনুরোধেও আমাদের ভাগ্যে কম্বল জোটেনি।
 পরদিন আবার বৃষ্টি। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। জঙ্গল। হালকা চড়াই। তারপর থারেপট্টি। থারেপট্টি একটা গিরিশিরার উপরে। লম্বা রাস্তার দুধারে ঘরবাড়ি ঘাসের লনে। আবার চা। যতক্ষণ চা খেলাম, একটি ছেলে আমাদের দোতারার মত একটা যন্ত্র বাজিয়ে শোনাল। আমরা চলে গেলাম তবুও সে তার বাড়ির সিঁড়িতে বসে বসে নেপালি সুর বাজাতে লাগল। সে সুর সামনের পাহাড়ে বয়ে চলল। সামনে জঙ্গলের রাস্তায় গোপ্তে। সুর বয়ে চলেছে সেই দিকে। ডানদিকে মেলামচি গাঁও হয়ে হেলাম্বু উপত্যকা। আমরা চললাম গোপ্তে। একটাই হোটেল এখানে। ভাত খাওয়া যায়। সামনে কাঠের লগ দিয়ে ভারি চমৎকার একটা চেয়ার টেবিল বানানো। উপকরণ অতি সামান্য কিন্তু শিল্পসুষমায় অনন্য। সেই চেয়ার টেবিলে বসে সামনের এলিয়ে পড়া বিস্তৃত উপত্যকায় স্তরে স্তরে ভেসে যাওয়া ঘন মেঘের দিকে তাকিয়ে দুপুরের খাওয়া খেলাম।তারপর ঠিক ডানহাতে বিশাল উঁচু সবুজ গাছে ঢাকা একটা পাহাড়চূড়া দেখিয়ে হোটেল মালিক বললেন ওই ফেদি।


 এখান থেকে ফেদির ছোট্ট একটা টিনের চালা দেখা যাচ্ছিল। পূর্ণ উদ্যমে গোপ্তের হোটেল থেকে নিচে নামতে লাগলাম। জঙ্গলপথ। বৃষ্টি। সিঁড়ি। কোনোটাই অনুকূলে নয়। ঝড়ের বেগে নামছি। সিঁড়ি হাঁটু বরবাদ করে দিচ্ছে। বৃষ্টি ভিজিয়ে দিচ্ছে এমনকি পিঠে বয়ে নিয়ে যাওয়া জামাকাপড়ও। এবার চড়াই। মাঝে মাঝে ছোট ঝোরা। এগুলো কোনোটাই স্থায়ী নয়। বৃষ্টির বেগ যত বাড়ছে নতুন নতুন ঝোরার সৃষ্টি হচ্ছে। একটা ঝোরা, সিঁড়ির বেদনা, আবার ঝোরা। এই ভাবে প্রায় দশ বার ওঠানামা করে শেষে হৃদপিন্ড নিঃশ্বাসের সাথেই বেরিয়ে আসার আগেই পৌঁছালাম ফেদি। একটা হোটেল এখানে আছে। সেটা অদ্ভুত। খুব সঙ্কীর্ণ একটা কাঠের প্যাসেজের সামনে সারিসারি কাঠের শাটার দেওয়া ঘর। শাটার খুললেই বিছানা। ঘরে কোথাও দাঁড়াবার জায়গা নেই। প্যাসেজে দাঁড়িয়ে নিজের দেহকে শোবার ভঙ্গীতে সরাসরি ছুঁড়ে ফেলতে হবে বিছানায়। এখানে সুদৃশ্য ডাইনিং স্পেস নেই। আছে এক বিশাল গোল ফায়ার প্লেস তার চারধারে মাটিতে বসে হাতে খাবার নিয়ে খেতে হবে। সে তো হল। বাকি সঙ্গীদের দেখা নেই। রাত হয়ে যায়। কেউ আসেনা। শেষে হোটেল মালিক তার হেডটর্চ মাথায় পরে বেরিয়ে পড়ে খুঁজতে। বহুদূর থেকে ভেসে আসে বাসের প্যাঁপ্যাঁ—প্যাঁপ্যাঁ-প্যাঁআআআ। কষ্ট হচ্ছে ওর। তাই এই আওয়াজ করছে। হয়তো মনে পড়ছে বাড়ির কথা। গরম বিছানা আর পায়ের তলায় হাওয়াই চটি। কিন্তু আর একটু। তারপরে গোল হয়ে ফায়ার প্লেসের ধারে বসা। আজ আর রান্না করা হলনা।
    পরদিন আমাদের কথা ভেবেই আকাশ একটু পরিষ্কার হল। আজ সূরজকুন্ড পাস পেরোবার দিন। চড়াই পথ। বড় গাছ শেষ। ঘাসে মোড়া ঢেউখেলানো পাহাড়ের ঢাল। মাঝে মাঝে জুনিপার। মাঝে মাঝে বেগুনি ফুল। মাঝে মাঝে হলুদ। চলতে চলতে কুয়াশা এসে যায়। চারদিক ঢেকে গেল ঘন মেঘে। আরো কিছুক্ষণ চললে এসে যাবে পাস। হঠাৎ দেখি একটা বাড়ি। কারো দেখা নেই। ঘরে রেডিও চলছে। আমাদের দুজন পোর্টার আগে গেছে। তারা কোথয় কে জানে। আমাদের পিছনে আছে দলের বাকি সদস্য। তাদেরও দেখা নেই। আমি আর অমিয় আমরা দুজন সেই ঘরে বসে থাকি। মালিক এসে যায়। জিজ্ঞেস করি পাস কতদূর। আছে আরো কিছুটা। আরো বেশ কিছুক্ষণ পরে বহু নিচে বিন্দুর মত একজনকে দেখিয়ে বলে ‘উ তুমারে সাথ হ্যায়? তো কভি নেহি পৌঁছ পায়গা”। অতএব আজ এইখানে বিরতি। ইয়াকের শুকনো মাংস ঝাল করে ভাজা আর রক্সি দিয়ে সবাই কে চাঙ্গা করে তুলতে লাগল গৃহকর্তা। এমনকি আমাদের পিছু নেওয়া সেই সাহেব মেম কেও। তাদের অবস্থা আমাদের মতই করূণ। সময় বয়ে যায়। অলস বৃষ্টির দুপুর। যে দুজন পোর্টার আমাদের আগে চলে গেছিল কোনো সন্ধান নেই তাদের। এই বৃষ্টিতে কি করছে তারা? চিন্তা বাড়তে থাকে। অঘটন ঘটেনি তো কোনো? দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে আসে। কোথায় খুঁজব এবার? ঘন মেঘে কিচ্ছু দেখা যায়না তবু অকারনে বাইরে পায়চারি করি। বেশ কিছুক্ষণ পরে দুটি ছায়ামূর্তি দেখা গেল, যে দিকে পাস সেইদিক থেকে নেমে আসছে। এই তো আমাদের পোর্টার দুজন। পিঠে আমাদেরই রেশন। কোথায় ছিলে তোমরা? জানা গেল ওরা পাস পেরিয়ে চলে গেছিল গোঁসাইকুন্ড। সেখানে একটা হোটেল দেখে আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। আনেক্ষণ অপেক্ষার পরও আমরা না আসায় আবার পাস টপকে এসেছে উল্টোদিকে। মাথায় হাত আমাদের। ওদের মুখে হাসি। আমাকে আর অমিয়কে দেখিয়ে বলে আপনাদের তো দেখেছি অনেক আগে। ভাবলাম পেরিয়ে গেছেন পাস। আবার হাসি।
       পরদিন সত্যিই পাস পেরোলাম। সময় লাগল ২ ঘণ্টা। রাস্তা সহজ। অনেক উঁচু থেকে দেখলাম গোল গোঁসাইকুন্ডকে। আর দেখলাম সত্তরোর্ধ এক জাপানি মহিলাকে। গোলাপি মুখে অসংখ্য বলিরেখা। আমাদের ফেলে আসা পথের দিকে উনি উঠে যাচ্ছেন। বয়স কোনো বাধা নয়। গোঁসাইকুন্ড মেঘে ঢাকা। মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে পুণ্যার্জন হল। সমস্ত হোটেল গোঁসাইকুন্ডের এক কোণে আর কুন্ড থেকে কিছুটা দূরে। তাই জায়গাটা পরিষ্কার। আমরা জনপ্রিয় ট্রেকরুটে এসে পড়েছি। রান্নার আনুমতি যদিওবা পেয়েছি, সমস্যা হল কিচেন নিয়ে। রাঁধব কোথায়? ঘরের সামনে একটা কাঠের বারান্দা। সেখানে স্টোভ জ্বালিয়ে ভাজলাম উচ্ছে। হ্যাঁ, উচ্ছে আমরা নিয়ে গেছিলাম বাড়ি থেকে। বৃষ্টির দাপটে রাঁধা হয়নি। চারিদিকে জার্মান বেকারি। কেকের সুবাস। বিলিতি খাবারের দাপট। তার মধ্যে এই উচ্ছে ভাজা। জিনিসটা দেখতে এগিয়ে এল নেপালিরাও। তাদের মধ্যে এই হোটেলের রাঁধুনিরাও আছে। বললাম খাও ভাই তোমরা। মুখে দিয়ে চোখ গোল গোল হয়ে উঠল ওদের। আরো দাও। যদি কাঁচা থাকে তাও রেখে যাও। আর এই হল কিচেন। এই নাও গ্যাসের উনুন। যতখুশি রাঁধো। এইভাবে বাহির আমাদের ঘর হয়ে উঠল। কিচেনে ঢুকে পড়ি সবাই। আর জোর গুলতানি। বাইরে ডাইনিং স্পেসে গম্ভীর মুখে সাহেবরা খেতে লাগল চাউমিন আর আমরা চর্বচোষ্যলেহ্যপেয়। খেতে খেতে সেই আওয়াজ প্যাঁপ্যাঁ—প্যাঁপ্যাঁ-প্যাঁআআআ। হ্যাঁ, বাড়িতে আছি। বাড়ি। এতদিন ধরে ভিজেছি। চড়াইপথে হাঁটু খুলে গেছে। শীতের পোষাক পর্যন্ত ভিজে একশা। হোটেলে কম্বলের জন্য ছলচাতুরি করতে হয়। কিন্তু এই উচ্ছে ভাজা এইটা মানে বাড়ি।
  পরদিন নেমে আসি লৌরি বিনায়ক। আবার বৃষ্টি। আবার ডোঙা মাথায় বিরক্তিকর হাঁটা। একটাও জামাকাপড় শুকনো নেই। মনে আর জোর নেই। থেকে থেকে আমাদের সঙ্গী ডাক দিয়ে ওঠে প্যাঁপ্যাঁ—প্যাঁপ্যাঁ-প্যাঁআআআ। কতদূর বাড়ি? লৌরিবিনায়ক থেকে সিনগোম্ফা সেখান থেকে থুলো-সিয়াব্রু। এর মাঝে পড়ে চাঙ্গেলপেতি। সেখানে একজন পরামর্শ দিলেন শর্টকাট নেওয়ার। চাঙ্গেলপেতি জঙ্গলঘেরা ছায়াচ্ছন্ন। বৌদ্ধ প্রার্থনা-পতাকা আছে। ডান দিকে ওই শর্টকাট। জঙ্গলঘেরা অচেনা পথে নেমে চললাম। অসম্ভব নীরবতা চারিদিকে। জনপ্রানী নেই। তায় বৃষ্টি। আমাদের একবারও মনে হলনা এই বৃষ্টিতে এই আজানা পথে একবার যদি হারাই কি দুর্ভোগ হবে কপালে। এতটাই মরিয়া ছিলাম কম সময়ে থুলো-সিয়াব্রু পৌঁছাতে। ভয়ানক কর্দমাক্ত রাস্তা। আছাড় খাচ্ছি ঘনঘন। সোজা হয়ে দাঁডিয়ে থাকা দায়। পথ হারিয়েছি এটা যখন প্রায় নিশ্চিত, এল মুখারকা। ছোট্ট একটা বাড়ি। এক বয়স্ক দম্পতি থাকেন সেখানে।  তাঁরা মাত্র দুজন, ব্যাস। বুড়ি সেলাই করে ভেড়ার লোমের কোট, মাফলার। বুড়োর কাশি হয় যে। আগে বুড়ো কাজ করত ইন্ডিয়ায়। মানালিতে কোথাও। সামনের বসার ঘর অনেক বড়। কাদামাখা আমরা সেখানেই বসে পড়ি। আমরাও তো ইন্ডিয়ার। বুড়োর ছবি তুলি। বুড়ি জড়িয়ে ধরে আমাদের। চা খাব আমরা। রিটায়ার করার পর এমন একটা বাড়ি করেছে ওরা। শুধু দুজনের বাড়ি। বৃষ্টি-মেঘ মেখে ওরা বসে আছে। কি নিয়ে ওরা বাঁচে? এই প্রকৃতি? আমাদের বলেছিল থেকে যাও। যদি চলেও যাও আবার এসো। তোমাদের জন্য খোলা থকবে দরজা। চিঠি লিখলে ঠিকানায় লিখবে মুখারকা। চলে আসবে আমাদের কাছে। কোনো পোস্টম্যান কি আসে এখানে? বিশ্বাস হয়না। বুড়ো গল্প করতে থাকে ইন্ডিয়ার। যেন সেটা তারই দেশ। আর তার আবসরের দেশ মুখারকা। যদি মারা যেতে হয় তবে সেটা এই মুখারকায়। এই জঙ্গলের দেশে।

     আমরা ঠিক করে নিলাম আর না। চলো সিয়াব্রুবেনসি। সেখানে সত্যি বাসের হর্ণ বাজে প্যাঁপ্যাঁ—প্যাঁপ্যাঁ-প্যাঁআআআ। সেখান থেকে সোজা কাটমান্ডু। সিয়াব্রুবেনসিতে ল্যাংট্যাং খোলা আর ভোটে খোলা মিলিত হয়েছে। আহা ওদিকে ছিল ল্যাংট্যাং। যাওয়া হলনা আমাদের। একটা ঘর পাওয়া গেল। মালিক সদাশয়। তবে রান্নায় আমাদের আর মন নেই। কি হবে। সিয়াব্রুবেনসি থেকে দুটোমাত্র বাস যায় কাটমান্ডু। খুব ভীড় হয়। বিছানায় শুয়ে পড়লাম। কাল ফিরে যাব। গোছগাছ শেষ। বাইরে বৃষ্টি অবিরাম। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ। চারিদিক শুনশান। ভাবলাম আজই তো শেষ। আর একবার বাইরেটা দেখে নিই। দরজা খুলে থমকে গেলাম। চোখ আপনিই চলে গেল আকাশের দিকে। আকাশ তারায় তারা। এতদিন যে আকাশের প্রার্থনা করেছি আকুলভাবে আজ যাবার দিন তাকে পাওয়া গেল। সবাইকে ডেকে তুললাম। আচ্ছা আরও কয়েকটা দিন তো আছে আমাদের হাতে। যদি এখনও শুরু করি আবার, আর যদি খুব জোরে যাই, দেখে তো আসতেই পারি ল্যাংট্যাং। কিন্তু চলতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। ঘর নিস্তব্ধ। তারপর গোটা দল দুভাগে ভাগ হয়ে গেল। পাঁচজন ল্যাংট্যাং যেতে রাজি। বাকিরা নয়। কারোর কারোর শরীর সত্যিই খুব খারাপ। একজন বিছানায় শুয়ে খুব ধীরে আওয়াজ করল প্যাঁপ্যাঁ—প্যাঁপ্যাঁ-প্যাঁআআআ। বড় করুণ বিষন্ন সে শব্দ। ওই হর্ণের মানে বাড়ি। এবার সত্যি সত্যিই বাড়ি।
  সকাল সকাল সমস্ত পোর্টারদের ছেড়ে দিলাম। টাকা পেয়ে ওরা ভারি খুশি, বাড়ি যাবে ওরাও। সূর্যের আলো পেয়ে আমাদেরও শরীর চনমন করে উঠল। অতএব দৌড়। বাম্বুলজ, রিমচে, রিভারসাইড লজ গুগলের দৌলতে সবাই আপনারা জানেন। আর দেখেন তো কি দারুণ সব ছবি। আমরাও সেই রকম ছবির মত সব দেখেছি। কারন একদিনও বৃষ্টি হয়নি এরপর। তবে গল্পগুলো সব হারিয়ে গেছিল। সেই মেঘ সেই মুখারকা সেই উচ্ছেভাজা আর হয়নি। সব খাবার কিনেছি। তাতে পেট ভরেনি বলে চা এর জন্য টেবিলে রাখা চিনির পাত্র থেকে বিনিপয়সার একমুঠো চিনি নিয়ে খাবার পর মালিকের বিরক্তি মেশানো দৃষ্টিকে উপেক্ষা করেছি।

   শুধু উপেক্ষা করতে পারিনি তাশি দেলেককে। আরেকটা বাড়ি সে খোঁজ করছে। সে বাড়ি জীবন যুদ্ধে এত বিডম্বিত নয়। কাটমান্ডুর আপাত মসৃণ জীবন সে দেখেছে। এই দেশ আর তার নয়। মুখারকার বুড়োবুড়ির দেশ আবার এটাই। এই সবুজ ঘাস আর ধোঁয়া ওঠা বৃষ্টি। যতদিন ভিনদেশের কাচের জানলার ফাঁক দিয়ে তাশি তার দেশের সেই বৃষ্টিমাখানো বনগন্ধ না পায় ততদিন আমাকেও লেখনী চালিয়ে যেতে হবে। তবে আজ ‘তাশি দেলেক’। তিব্বতি ভাষা্র এই শব্দের মানে জানেন তো পাঠক? “নমস্কার’।  
  

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ