ছট
ছট
“দক্ষিণা ঊষার রথ সংযোজিত হয়েছে। মরণরহিত দেবগণ
এ রথে আরোহণ করলেন। কৃষ্ণবর্ণ অন্ধকার হতে পূজনীয়া, বিচিত্র গতিমতি ও মনুষ্য
আবাসের রোগনাশিণী ঊষা উদয় হলেন”
- ঋক
বেদ-১২৩ সূক্ত
ছট নিয়ে এত দিনে আপনারা যা জেনেই গেছেনঃ-
ছট পরব বছরে
দুবার পালন করতে দেখে থাকবেন। এক তো চৈত্র মাসে হোলির কিছুদিন পরে, আরেকবার কার্তিক মাসে। আমরা যাঁরা বিহার-ঝাড়খন্ডের আশেপাশেই থাকি তারা এই দুই সময়ের ছটই
দেখেছি। তবে ছট পূজোয় দীর্ঘ সময় উপবাসের একটা ব্যাপার থাকে যেটা চৈত্রমাসের গরমে
পালন করা কষ্টকর। তাই চৈতি ছট এর রমরমাও
কম। কার্তিক শুক্লা ষষ্ঠীতে হয় কার্তিক মাসের ছট। মানে কালীপুজোর ছ দিন পরেই। এখন,
কারো কারো মতে ষষ্ঠী থেকেই ছট শব্দ এসেছে। কেউ বলছেন সূর্যের ছটা থেকে ছট।
অস্তগামী এবং উদীয়মান সূর্যের দিকে তাকিয়ে তাকে বন্দনা করাই ছট পুজো। যে প্রশ্নটা
সকলেই করেন সেটা হল সূর্যদেব তো পুরুষ আর ছট যদি সূর্যের পুজোই হবে তবে ছটপুজোর
গানে তাঁকে ছটি মাইয়া বলে বন্দনা করা হচ্ছে কেন? এর নানাবিধ উত্তর পাওয়া গেছে। কেউ
বলছেন ছট আসলে ঊষার পুজো। পৌরাণিক অভিধানে লিখছে- ‘ঊষা সূর্যের জনয়িত্রী; সূর্য
প্রণয়ীর ন্যায় এই সুন্দরী দেবীর অনুগমন করেন। সূর্য ঊষার কোলে দীপ্তি পান, আবার
ঊষা এঁর স্ত্রী’।(যদিও সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর ‘প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ’ বইতে
বলছেন সূর্য ঊষার উপপতি, কারণ হিসেবে তিনি ‘জারোন’ শব্দটির বহুল ব্যাবহারের প্রতি
মনযোগ আকর্ষন করেছেন) তাই ‘ছটি মাইয়া’ বলে সূর্যকে নয়, বন্দনা করা হচ্ছে ঊষাকে।
ছটের কোনো মূর্তি নেই। ইদানীং ছট ঘাটে রথে-আসীন একটি পুরুষ মূর্তি দেখা গেলেও তার
পূজাবিধি নেই। এমন কি লোকগান ছাড়া শুধুমাত্র ছটপূজার নির্দিষ্ট মন্ত্রও নেই। ঋকবেদে
সূর্যস্তব আছে সেখানে সূর্য কিন্তু একজন দেবতা, জ্যোতির্ময় জড়পিন্ড নন। আরেকটি
গল্প আমার জানা ছিল না সেটি সমীরণ নন্দীর ফেসবুক পোস্ট মারফৎ জানা হল- যেখানে লেখক
বলছেন সূর্যের তাপে ফসল শুকিয়ে গেলে অন্নপূর্ণা সুর্যের আরাধনা করেন তাতে সূর্য
আরো তেজোবান হওয়ায় দেবতারা তাঁর শরণাপন্ন হলে তিনিই মা অন্নপূর্ণাকে গঙ্গাজলে
অর্ধনিমজ্জিত হয়ে অস্তগামী এবং উদীয়মান সূর্যের স্তব করার পরামর্শ দেন। তাই ছট পূজোর মধ্যে দিয়ে
সুর্যদেব মা অন্নপূর্ণা ও গঙ্গা দেবী তিনজনকেই পূজো করা হচ্ছে। কাহিনীটি অর্বাচীন
হলেও এটা হতেই পারে, কারন ছটের সময় বিগত বছরে ভাল ফসলের জন্য অস্তগামী সূর্যকে
ধন্যবাদ দেওয়ার রীতি আছে আর আছে সকালের সূর্যের কাছে প্রার্থনা- আগামী বছরে ফসল
যেন ভালো হয়।
ছট পূজোর রীতিনীতিঃ-
ছট তো এখন একটা
ব্রত। তাই এর সঙ্গে উপবাসের যোগ রয়েছে। মোট চার দিনের সংযম পালনের মধ্য দিয়ে ব্রত
সমাপ্ত হয়। প্রথম দিন ‘নাহায় খায়’। মানে হল- গঙ্গাস্নান করে গঙ্গা জল নিয়ে আসতে
হবে বাড়িতে, সেই জলে সব পরিশুদ্ধ করে প্রস্তুতি নিতে হবে পূজোর। এই দিন কেবলমাত্র
একবারই আহার করা যাবে। এই আহারে লাউ অবশ্য গ্রহণীয়। আমাদের এখানে ‘লাউভাত’ বলে
প্রচলিত। পরিশুদ্ধর কথায় মনে পড়ল ছটের প্রসাদ হিসেবে যে ঠেকুয়া তৈরী হয় তার জন্য
মোটা দানার বিশেষ গম অনেককেই আনতে দেখেছি। এই গম অতি যত্নে ধুয়ে মনুষ্য পাহারায়
রাখা হয়, যাতে কাকপক্ষী মুখ না দিতে পারে। যেহেতু এই গম আনা ধোয়া ব্যাপারটা একটু
আগেই শুরু হয় তাই কার্তিক মাসে রেল কোয়ার্টারের সামনে বিছিয়ে রাখা গমও ছট আসার
দ্যোতক ছিল আমাদের কাছে। পরিচ্ছন্নতার অঙ্গ হিসেবে ঘরে নতুন রং করা আর গোবর দিয়ে
বাগান নিকোতেও দেখেছি অনেককে। দ্বিতীয় দিন সারাদিনের উপোস ভঙ্গ হয় সূর্যাস্তের পরে। ক্ষীর-পুরি-কলা এইই
খাওয়া হয় সন্ধ্যেয়। এটাতে পাড়ার লোকও নিমন্ত্রিত হন, বন্ধুবান্ধব আসেন। এর পরে
দীর্ঘ ছত্রিশ ঘণ্টার উপবাস। তার মধ্যে তৃতীয় দিনে সন্ধ্যার অর্ঘ্য। পূজার ডালায়
থাকে গাঁদা ফুলের মালা, বাতাবি লেবু, আখ আরো নানা ফলমূল। সবটা একটা বড় ঝুড়িতে
রেখে ঝুড়িটাকে সাদা কাপড়ে মুড়ে বা তার উপর ক্রুশে বোনা রঙচঙে ঢাকনা রেখে সেই ঝুড়ি
মাথায় নিয়ে খালি পায়ে হেঁটে যেতে হয় জলের ধারে। তারপর নদীতে স্নান করে
আঁজলা করে জল নিয়ে সূর্যের উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য। এরপর যিনি ব্রতী তিনি সূর্যের দিকে
মুখ করে একেকটি ডালা একটু উঁচুতে তুলে ধরেন আর পুণ্যার্থীরা ঘটিতে করে তার সামনে
জলের ধারা বা দুধের ধারা দিতে থাকেন। এরপর বাড়ি ফেরা। পরদিন রাত থাকতে থাকতে আবার
নদীর ঘাটে। সামনে পূজোর সামগ্রী ডালায় সাজিয়ে প্রদীপের আলো জ্বেলে পাড়ে দাঁড়িয়ে বা
বসে অপেক্ষা সূর্যোদয়ের। আর এই অপেক্ষার মধ্যেই চলে ছটের গান। এক সময়ে সেই
গানগুলোর বাংলা ভাবার্থ করেছিলাম। তার কিছু দেওয়া যেতে পারে-
ছটের গানঃ-
১
অজয়ের তীর বেশ খানিকটা অন্ধকার, অল্প দূরে দূরে গুচ্ছ গুচ্ছ মোমবাতির আলোয় বয়ে যাওয়া জলের রেখা। অন্ধকার আকাশে বাজির আল্পনা আর মাইকে ছটের গান। এই ছটের গান ছেলেবেলা থেকে শুনছি। কি যে বলে এই গানে তা কখনো তলিয়ে ভাবিনি। এবার হঠাৎ মনে হল গানের কথার প্রতি নজর দিলে হয়। খোঁজ নিয়ে জানলাম ছটের গান মৈথিলী আর ভোজপুরি এই দুই ভাষায় লেখা। সেদিন অন্ধকারে যাঁরা মোমের আলোয় সামনে ডালা সাজিয়ে বসে গাইছিলেন আজ সেই গানের মর্মোদ্ধার হল। একজন গাইছেন- সূর্যদেব তোমার আজ উঠতে এত দেরি হচ্ছে কেন? সূর্যদেব জবাব দিলেন পথে আসতে আসতে এক অন্ধের সঙ্গে দেখা, সে অন্ধকে দৃষ্টি দান করতে হল। এরপর দেখা এক সন্তানহীনার সঙ্গে, তাকে সন্তানলাভের বর দিতে হল তারপর আবার দেখা এক কুষ্ঠ রোগীর সঙ্গে, তাকেও নিরাময় করতে হল। এ ভাবে আমার দেরি হল। সেদিনও সূর্য উঠতে দেরি হচ্ছিল। অবশেষে যখন ঘোলাটে আকাশ থেকে যখন গোল টিপের মত সূর্য দেখা গেল মর্ত্যেও শুরু হল সিঁদুর দান।
২
সূর্যঠাকুরের উঠতে দেরি হচ্ছে এমন একটা গান তো শুনলাম। আবার যিনি ছট করতে আসছেন তাঁরও দেরি হয়ে যায়। সেরকম গানও একটা আছে। গানগুলো শুনলে দুটো জিনিস মনে আসে। প্রথমত সব গানের সুরই বুঝি এক। দুই গানগুলো সবই বুঝি কোনো একজন মহিলাই গেয়েছেন। এর প্রথমটা সত্যি নয়। দ্বিতীয়টা বেশ খানিকটা সত্যি। ছটের দিন যেসব গান বাজে মাইকে তার বেশিরভাগটাই গেয়েছেন শারদা সিনহা। ভোজপুরি লোকগানের এই জনপ্রিয় মহিলা সঙ্গীতশিল্পী পদ্মশ্রীও পেয়েছেন। তাঁর একটা গানে ভক্ত বলছেন- আমি পাটনার ঘাটেই ছট করব অন্য কোনো ঘাটে যাব না। নদীর ঘাটে ডোম ডোমনী কুলো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের থেকে কুলো কিনেই আমি তোমায় অর্ঘ্য দেব। জাতিতে যাঁরা ডোম তাঁরাই কুলো বানান, তাই এমন কথা। এরপর বলছেন মালি মালিনী ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাদের কাছ থেকে ফুল কিনে মালা গেঁথে তোমায় অর্ঘ্য দেব। এরা সবাই তো দাঁড়িয়ে আছে নদীর পাড়ে। কিন্তু পুজো করতে তো ফল লাগে, কলা আপেল নারকেল। সে সব কিনতে যেতে হয় বাজারে, সেখানেই বড্ড দেরি হয়ে গেল। সে ভুলের অপরাধ নিও না মা। আমার অর্ঘ্য নিও। আমি পাটনার ঘাটেই ছট করব অন্য কোনো ঘাটে যাব না। ভোজপুরি এই গানটি বাংলা হরফে লিখে দিলাম। আর ভাবলাম আমাদেরই বা যাবার জায়গা আছে কোথায়? এই অজয়ের জলই গঙ্গাজলবৎ।
পাটনা কে ঘাট পর হামহুঁ অরঘিয়া দেবৈ হে ছটি মাইয়া
পাটনা কে ঘাট পর হামহুঁ অরঘিয়া দেবৈ হে ছটি মাইয়া
হম না যাইবি দোসর ঘাট দেখব হে ছটি মাইয়া
সুপ লেল থাড় বাড় ডোম ডোমনিয়া,দেখব হে ছটি মাইয়া
ওহি সুপি অরঘ দেবয় দেখব হে ছটি মাইয়া
ফুল লেল থাড় বাড় মালিয়া মালিনিয়া,দেখব হে ছটি মাইয়া
ওহি ফুলে হারোয়া গোথায়, দেখব হে ছটি মাইয়া
কেলা সেও নারিয়েল কিন গৈনি বাজারিয়া,দেখব হে ছটি মাইয়া
ওথহি লাগল বড়ি দের, দেখব হে ছটি মাইয়া
ভুল চুক হামরি মাইয়া, রাখব না ধিয়ানিয়া,দেখ0ব হে ছটি মাইয়া
হামরো অরঘিয়া দেহব মান,দেখব হে ছটি মাইয়া
পাটনা কে ঘাট পর হামহুঁ অরঘিয়া দেবৈ হে ছটি মাইয়া
হম না যাইবি দোসর ঘাট দেখব হে ছটি মাইয়া।
৪
জনপ্রিয় ছটের গান সংগ্রহ করতে করতে একটা নতুন ধরনের গান পাওয়া গেল। আগে গানটি লিখে ফেলা যাক-
উ যে কেরোয়া যে ফরেলা খবদ সে,
ওহ পর সুগা মেড়রায়
মারবো রে সুগওয়া ধনুখ সে, সুগা
গিরে মুরছায়
উ যে সুগানি যে রোয়েলে বিয়োগ সে, আদিত
হুই না সহায়।
উ যে নারিয়ার যে ফরেলা খবদ সে,
ওহ পর সুগা মেড়রায়
মারবো রে সুগওয়া ধনুখ সে, সুগা
গিরে মুরছায়
উ যে সুগানি যে রোয়েলে বিয়োগ সে, আদিত
হুই না সহায়।
আমরুদওয়া যে ফরেলা খবদ সে,
ওহ পর সুগা মেড়রায়
মারবো রে সুগওয়া ধনুখ সে, সুগা
গিরে মুরছায়
উ যে সুগানি যে রোয়েলে বিয়োগ সে, আদিত
হুই না সহায়।
শরিফওয়া যে ফরেলা খবদ সে,
ওহ পর সুগা মেড়রায়
মারবো রে সুগওয়া ধনুখ সে, সুগা
গিরে মুরছায়
উ যে সুগানি যে রোয়েলে বিয়োগ সে, আদিত
হুই না সহায়।
নারাঙ্গিয়া যে ফরেলা খবদ সে,
ওহ পর সুগা মেড়রায়
মারবো রে সুগওয়া ধনুখ সে, সুগা
গিরে মুরছায়
উ যে সুগানি যে রোয়েলে বিয়োগ সে, আদিত
হুই না সহায়।
উ যে সেউয়া যে ফরেলা খবদ সে,
ওহ পর সুগা মেড়রায়
মারবো রে সুগওয়া ধনুখ সে, সুগা
গিরে মুরছায়
উ যে সুগানি যে রোয়েলে বিয়োগ সে, আদিত
হুই না সহায়।
সবে ফলওয়া যে ফরেলা খবদ সে,
ওহ পর সুগা মেড়রায়
মারবো রে সুগওয়া ধনুখ সে, সুগা
গিরে মুরছায়
উ যে সুগানি যে রোয়েলে বিয়োগ সে, আদিত
হুই না সহায়।
গানটির কথা অতীব সরল। এক টিয়াপাখি ফলের গাছে এসে বসেছে, সে ফল খাবে কিছুটা বা ঠুকরে নষ্ট করবে। এখন সেই ফল গাছগুলির মালিক পাখিটিকে গাছে বসতে দেখতে পেয়েছে। সে পাখিটিকে সাবধান করছে এই বলে যে ধনুকে শর যোজনা করে তাকে মেরে ফেলবে। এর পর তীরের আঘাতে পাখি গাছ থেকে মূর্ছিত হয়ে পড়েছে, হয়ত বা মরেই গেছে। পাখির সঙ্গীনী এখন কেঁদে ফিরছে। তখন সেই হত্যাকারীই আবার সুর্যদেবকে তার সহায় হতে বলছেন। মজার ব্যাপার হল, যে ব্যক্তি তার ফল গাছ বাঁচাতে পাখিকে মারছে সেই একই ব্যক্তি যেন পাখির সঙ্গীনীর বিয়োগব্যথা অনুভব করে কষ্ট পাচ্ছে। আরেকটা ব্যাপার ছটের (শুধু ছট নয় অন্যান্য অনেক দেব দেবীর পুজোয়) বেশিরভাগ গানেই একটা পার্থিব চাওয়া পাওয়া জড়িত থাকে, যেমন ছট ব্রত পালনের ফলে সন্তানহীনার সন্তান হয়, কুষ্ঠ রোগী রোগমুক্ত হয় এইসব। কিন্তু আশ্চর্য এই গানে বিশুদ্ধ বিচ্ছেদের ব্যথা ছাড়া আর কিছুই নেই। এমন কি ঈশ্বর অলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে পাখিটিকে জীবিত করে তুলবেন এমন ইঙ্গিত পর্যন্ত নেই। বরং পাখিটি যে আর বেঁচে উঠবে না এরকমই মনে হয়। তবে এটা ভেবে দেখা হয়নি যে এই গানের মধ্যে কোনো গূঢ় তত্ব বা রূপকাশ্রিত কোনো বার্তা আছে কি না। যদিও সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। একেবারে নেই বলা গেল না কারন গানটির রচয়িতার নাম পাওয়া যায় নি, দূর অতীত থেকে লোকমুখে চলে আসছে। এ গান নানা ভাবে রেকর্ড হয়েছে। কোথাও কোথাও এ গানের সবচেয়ে শংশয়ের জায়গা ‘আদিত হুই না সহায়’ এই বাক্যটিই অনুপস্থিত। কোথাও আবার যেন সূর্যদেবকে নালিশ করা হচ্ছে পাখি ফল এঁটো করে দিচ্ছে তিনিই যেন সমুচিত শাস্তির ব্যবস্থা করেন। এইভাবে গানটিতে একটা আপাত যৌক্তিকতা আনার চেষ্টা হয়েছে অবশ্যই কাব্যমূল্য বিসর্জনের বিনিময়ে। তবে আমার কাছে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য আর কবিত্বপূর্ণ মনে হয়েছে উপরের সংষ্করণটি। মোটের উপর গানটিতে বিচ্ছেদ বেদনা আর সূর্যদেবের কাছে পাখিটির জীবনভিক্ষার প্রচ্ছন্ন সুর মনকে আর্দ্র করে।
তো, এই সব গানের পরে আবার গত সন্ধ্যার কৃত্য পুনর্বার করতে হয় সূর্যোদয়ের কালে। ব্রতী হাত পাতেন ভক্তের কাছে। ভক্ত একটি সিঁদুরের বাটি থেকে আঙ্গুলে করে সিঁদুর নিয়ে তিনবার রেখা কেটে দেন ব্রতীর হাতে। তারপর দেন চাল। তার উপরে থাকে পূজোর ডালা সেই ডালা নিয়ে তিনপাক ঘুরে সূর্যকে অর্ঘ্য দিয়ে স্নান। যদি একাধিক লোক একই ব্রতীর মাধ্যমে পূজো দিতে চান তবে আলাদা আলাদা ডালা হাতে নিয়ে ব্রতী প্রত্যেকটি ডালার জন্য ওই সিঁদুরের রেখা থেকে স্নান পর্যন্ত চক্রটি প্রতিবার সম্পাদন করেন। ছট পূজোয় কোনো পুরুতমশায় লাগে না।
৩
কার্তিক মাসে প্রেতেরা স্বর্গ থেকে নেমে মর্তের খুব কাছাকাছি এসে পড়েন। রাত্তিরে অল্প অল্প হিম পড়ে। ভোরবেলা মাড়িয়ে দেওয়ার আগে পর্যন্ত ঘাসের আগায় সে জলবিন্দু পরিষ্কার দেখা যায়। এক দৃষ্টিতে গোটা পৃথিবীর যতটুকু ধরা পড়ে, ভালো করে লক্ষ করলে একেকটা জলবিন্দুতে তারই একটা নিটোল ছবিও পাওয়া যায়। এই শিশিরকণাগুলি যেন মৃত আত্মা যাদের বুকের মধ্যে লুকিয়ে আছে ফেলে আসা পৃথিবীর গভীর মায়া, অপূর্ণ বাসনা। বছরের এই একটা সময়েই তাঁরা এত কাছাকাছি হতে পারেন তাঁদের পরিজনের। আমরা যতই খন্ডিত আত্মার পূর্ণে মিশে যাওয়ার ধারণা তৈরি করিনা কেন এখনো ভাবি মৃত আত্মারা আমাদের কাছাকাছিই আছেন, ডাকলে এই সাড়া দিলেন বলে। সেই আশাতেই আকাশপ্রদীপ উঁচু করে টাঙ্গিয়ে দিই, বলি এই যে আমার বাড়ির চিহ্ন, আমার স্নেহভাজন আমার শ্রদ্ধাভাজন পথ ভুল কোরো না। ছটের সঙ্গে মৃতদের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে সেদিন অজয়ের ঘাটে রাতের আকাশে অনেক ফানুস ওড়ানো দেখে মনে হল ছেলেবেলায় আমাদের পাড়ার বেশ কিছু বাড়িতে টাঙানো আকাশপ্রদীপের কথা। তবে কার্তিক মাস, কার্তিক ঠাকুর আর আমাদের প্রিয়জনের সঙ্গে ছট পরবের সম্পর্ক আছে বৈকি। ছটের একটা গানে বলছে- কলাপাতার ফাঁকে সূর্য উঁকি দিচ্ছে, হে ব্রতধারী তুমি ছট করছ কেন? ব্রতধারী বলল আমার ঘরে যে পুত্র আছে তার মঙ্গল কামনায়। তখন আবার কেউ গেয়ে ঊঠল পেয়ারা পাতার ফাঁকে সূর্য উঠছে, হে ব্রতধারী তুমি ছট করছ কেন? ব্রতধারী বলল আমার ঘরে যে স্বামী আছে তার মঙ্গল কামনায়। এই ভাবে সে ক্রমে ক্রমে তার সকল প্রিয়জনের কথা বলে চলে। আমার প্রিয় যে মানুষ সে জীবিত বা মৃত তার কথা এই উৎসবের দিনে বারবার মনে পড়ে সে আকাশপ্রদীপে হোক বা ছটের অর্ঘ্যে ছলে বলে তার ভালোই আমি চাই। পড়া যাক এই গানটি-
কেলোয়া কে পাত পর উগলেন
সুরুযমল ঝাঁকে ঝুঁকে
এ করেলু ছট বরতিয়া ঝাঁকে ঝুঁকে
হম তোসে পুছি বরতিয়া এ বরতিয়া সে কেকরা লাগি
করেলু ছট বরতিয়া সে কেকরা লাগি
হমরোযে বেটোয়া কওনো এইসন বেটোয়া সে উনকে লাগি
সে করেলি ছট বরতিয়া
আ্ম্রুতিয়াকে পাতপর উগলে্ন সুরুযমল ঝাঁকে ঝুঁকে
এ করেলু ছট বরতিয়া ঝাঁকে ঝুঁকে
হম তোসে পুছি বরতিয়া এ বরতিয়া সে কেকরা লাগি
করেলু ছট বরতিয়া সে কেকরা লাগি
হমরোযে স্বামী কওনো এইসন স্বামী সে উনকে লাগি
সে করেলি ছট বরতিয়া উনকে লাগি
নারিয়েল কে পাত পর উগলেন সুরুযমল ঝাঁকে ঝুঁকে
এ করেলু ছট বরতিয়া ঝাঁকে ঝুঁকে
হম তোসে পুছি বরতিয়া এ বরতিয়া সে কেকরা লাগি
করেলু ছট বরতিয়া সে কেকরা লাগি
হমরোযে বেটি কওনো এইসন বেটিয়া সে উনকে লাগি
সে করেলি ছট বরতিয়া।
হম তোসে পুছি বরতিয়া এ বরতিয়া সে কেকরা লাগি
করেলু ছট বরতিয়া সে কেকরা লাগি
হমরোযে বেটোয়া কওনো এইসন বেটোয়া সে উনকে লাগি
সে করেলি ছট বরতিয়া
আ্ম্রুতিয়াকে পাতপর উগলে্ন সুরুযমল ঝাঁকে ঝুঁকে
এ করেলু ছট বরতিয়া ঝাঁকে ঝুঁকে
হম তোসে পুছি বরতিয়া এ বরতিয়া সে কেকরা লাগি
করেলু ছট বরতিয়া সে কেকরা লাগি
হমরোযে স্বামী কওনো এইসন স্বামী সে উনকে লাগি
সে করেলি ছট বরতিয়া উনকে লাগি
নারিয়েল কে পাত পর উগলেন সুরুযমল ঝাঁকে ঝুঁকে
এ করেলু ছট বরতিয়া ঝাঁকে ঝুঁকে
হম তোসে পুছি বরতিয়া এ বরতিয়া সে কেকরা লাগি
করেলু ছট বরতিয়া সে কেকরা লাগি
হমরোযে বেটি কওনো এইসন বেটিয়া সে উনকে লাগি
সে করেলি ছট বরতিয়া।
ছট করলে কি হয়ঃ-
সোজা
কথায় অপুত্রের পুত্র হয়, নির্ধনের ধন। ছটের গান শুনতে শুনতে
একটা পাঁচালি শুনেছিলাম সেটা সূর্যদেবের মহিমা কীর্তন। তার প্রথম গল্পটা শাম্ব কে
নিয়ে। শাম্ব শ্রীকৃষ্ণের পুত্র। একদিন রৈবতকের প্রমোদকাননে রমনীমোহন শাম্বকে দেখে
কৃষ্ণের সামনেই তাঁর ষোলহাজার স্ত্রী শাম্বের প্রতি কামাসক্ত হয়ে পড়লেন। ক্রুদ্ধ
কৃষ্ণ স্ত্রীদের অভিশাপ দিলেন তাঁর মৃত্যুর পরে স্ত্রীরা সকলেই তস্কর দ্বারা
লুন্ঠিত হবেন আর শাম্বকে বললেন তার রমনীমোহন শরীর কুষ্ঠরোগাক্রান্ত হবে। কিন্তু এ
সবই হচ্ছিল মুনি নারদের অঙ্গুলিহেলনে। যা হোক, কিছুদিন পর শাম্বের শরীরে রোগলক্ষণ
প্রকট হল। শাম্ব নারদের শরণাপন্ন
হলেন। নারদ বললেন একমাত্র অনাবৃত দর্শিত ঈশ্বর হচ্ছেন সূর্য, যিনি সব রোগ হরণ
করেন। তুমি নিরাময়ের জন্য তাঁর পূজা কর। তারপর কিভাবে শাম্ব সূর্য পূজা করলেন ও
কুষ্ঠ রোগ থেকে মুক্ত হলেন তার বর্ণনা ছিল গানটিতে। সুতরাং ছট করলে চর্মরোগ
দূরীভূত হয়। যদিও যাঁরা সমরেশ বসুর শাম্ব উপন্যাসটি পড়েছেন তাঁরা জানবেন। এর পরেও
শাম্বকে ভিন্ন দেশ থেকে মগ ব্রাহ্মণদের নিয়ে আসতে হয়েছিল ভারত থেকে কুষ্ঠ
দূরীকরণের উদ্দেশ্যে।
শেষ কথাঃ-
ছটের ভালো ভাল কয়েকটি দিক আছে। প্রথম তো পুরোহিতের খবরদারি
নেই। এখানে নিয়ম-সংযম পালনকারী যে কোনো মানুষই পুজো করতে পারেন। দ্বিতীয়ত
মন্ত্রতন্রের বিশেষ ভূমিকা নেই। একমনে ডাকলেই হল। তারপর আদিতে এটা যথেষ্ট পরিবেশ
বান্ধব পূজোই ছিল। পূজোর ফলমূল সব গোটা গোটা, সেগুলো ফেলে যাওয়ার কোনো ব্যাপার
নেই। কিছু ফুল থাকে বটে, তবে সেটা তত কিছু দূষণীয় নয়। মূর্তি নেই বলে ভাসানে গিয়ে
মূর্তি ফেলে রেখে ঘাট নোংরা করার ব্যাপারও নেই। সেদিক থেকে দেখতে গেলে স্বল্প
উপকরণে, এটা তো পরিবেশের মঙ্গলেরই জন্য, প্রকৃতির দাক্ষিণ্য পাওয়ার আকাঙ্খায় তার
কাছে প্রণত হওয়ার গল্প। তবে এই পুজো নিয়ে ভক্তদের এত আস্ফালন, এত বাহুবলের প্রকাশ
কেন? আদালতের রায় অগ্রাহ্য করে সংরক্ষিত জলাশয়েই ছট পালনের এই উগ্র ইচ্ছার কারনটা
কি? হয়ত এর সঙ্গে ছট পুজোর কোনো সম্পর্কই নেই। এক বন্ধু বলছিলেন এটা আসলে পুজো
উপলক্ষ করে একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর ক্ষমতা প্রকাশের আয়োজনমাত্র। এই আস্ফালনের মধ্য
দিয়ে বঙ্গীয় রাজনৈতিক আঙিনায় তাঁদের গরিষ্ঠ উপস্থিতিকে যেন স্মরণ করিয়ে দেওয়া হল।
রাজনীতিবিদরা ভাববেন। তবে রোগ শুধু বঙ্গের পশ্চিমদেশীয় লোকেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ
এমন ভাবলে ভুল হবে। নিভৃত প্রাণের দেবতা এখন আর ভক্তের মনে একা জাগেন না।
তাঁকে পাওয়ার, সেই নির্জনকে ছোঁয়ার লক্ষ্য নিয়ে আর কেউ উৎসব করেন না। এখন যেহেতু
সব আকাঙ্খার জন্ম ও মৃত্যু অতি দ্রুত, তাই কবে পরিবেশের মঙ্গল হবে আর সেই মঙ্গলের
সুফল আদৌ আমি ভোগ করতে পারব কি না, সে সব সূদূরপরাহত চিন্তায় কালক্ষয় করে লাভ কি?
তার চেয়ে ফানুস ওড়াই। আমার মেমোরিকার্ড ভরে থাক স্মৃতিসুধায়। বিদায়ের সময় কারো
হাতে শূণ্য পাত্র ধরিয়ে যাচ্ছি কি না সে ভাবনায় কাজ কি? এই একটা ব্যাপারে চির
প্রতিদ্বন্দ্বী বাঙালি-বিহারী একাসনে বসেছে।
ছটের ছবিঃ-
ছোটোবেলায় দেখেছি ছট এলে ট্রেনে তিল ধারণের জায়গা থাকত না।
বিহারীরা কষ্ট সহিষ্ণু। রিজার্ভেশন না পেলেও তাঁরা ট্রেনের মেঝেতে বসে যেতেন। দেশে
যে অপেক্ষা করে আছেন তাঁদের প্রিয়জন। তাই এ কষ্টকে তাঁরা কষ্ট বলেই মনে করতেন না।
তাঁদের গাড়ির গায়ে যে লেখা আছে ‘ঘর আ জা পরদেশী’।
দারুন লাগলো লেখাটা পড়ে.... তথ্যসমৃদ্ধ রচনাশৈলীতে অনবদ্য
উত্তরমুছুনপড়লাম , ছ্ট নিয়ে একটা লেখা ভবিষ্যৎ-এর জন্য থেকে গেল মনে হচ্ছে ,গানগুলো তো বহু বছর ধরেই শুনছি ,সুরবৈচিত্র্য না থাকলেও একটা অদ্ভুত দোলা আছে এর মধ্যে , বাংলায় এর অনুবাদগুলো অসাধারণ ! তবে ' শেষকথা' নাড়িয়ে দিয়ে গেল , সত্যিই , প্রকৃতিকে পরিবেশকে শ্রদ্ধা ভালোবাসা দিয়ে যে আচারঅনুষ্ঠানের সূচনা হয়েছিলো আজ তাকে আমরা কোথায় নামিয়ে এনেছি ! !
উত্তরমুছুন