গুপ্তিপাড়ার রথের মেলা
গুপ্তিপাড়ার রথের মেলা
সেদিন কালো আকাশ
থেকে ঝিরঝির করে একটানা বৃষ্টি পড়ত সারা সন্ধ্যে, গলির মুখে ঠিক যেখানে পাঁউরুটিওয়ালার হর্ণ বাজে প্রতিদি্ন, সেখান
থেকে কেবল সেদিনই শোনা যেত হাত ঘণ্টার ঠুং ঠুং আওয়াজ, কাঁসরের কাঁইনানা।
পাঁঊরূটিওয়ালার থেকেও গভীর আগ্রহে সেদিন অপেক্ষায় থাকতাম একটা ছোট হাতের। কালো
ছাতার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা সে হাতের মুঠোয় ধরা আছে একটা বাতাসা, কচি আঙ্গুলের
ফাঁক দিয়ে বর্ষার জল ঢুকে যে বাতাসা ভিজে কাদা, তার মিঠে রস গড়িয়ে পড়ছে কনুই বেয়ে।
এখনো বর্ষা এলে গড়িয়ে আসা ভিজে বাতাসার স্বাদ, আরেকটু বড় হলে তাতে লেগেছিল লবণের
ছোঁওয়া, যখন পড়ছি- একটি রাঙা লাঠি কিনবে একটি পয়সা নাহি। সেদিন থেকে রথের মেলা
আমার কাছে হয়ে উঠেছিল চিরকরুণ। রথ তো কত দেবতারই হয়। যিনি দেবতা হতে চাননি সেই
বুদ্ধ থেকে ধর্মঠাকুর পর্যন্ত সকলেই রথে চড়েছেন, তবে শ্রীজগন্নাথদেবের রথের সঙ্গে
যে আনন্দ-বেদনার পরশ লাগে মনে, তা আর কোথায় মিলবে! রথের জন্য তাই বাছলাম
গুপ্তিপাড়াকে। কারণ গুপ্তিপাড়ার রথ তো শুধুই একটা রথযাত্রার অনুষ্ঠান নয়, তার পরতে
পরতে ইতিহাসের ছোঁয়া, সত্যিমিথ্যা গল্পের বুনন। সেই অফুরন্ত গল্পের টানে সময় করে
আজও যাই সেখানে বারবার।
চৈতন্যদেব মন্দির
গুপ্তিপাড়া মঠ
গুপ্তিপাড়ার রথ
বৃন্দাবনচন্দ্রের রথ। কিন্তু এই বৃন্দাবনচন্দ্র গুপ্তিপাড়ায় এলেন কোথা থেকে? সে
নিয়ে একটা গল্প আছে। ভাগিরথীর পশ্চিমপাড়ে গুপ্তিপাড়া আর তার ঠিক উল্টোদিকে
পূর্বপাড়ে শান্তিপুর। এক পারে প্রখর বিদ্যাচর্চা অন্য পারে বণিকের ধনের সাধনা।
একদিন শান্তিপুরের এক নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ভাগিরথীতে স্নানের সময় অলৌকিক ভাবে
নদীমধ্যে বংশীহাতে খানিক বেঁকে দাঁড়ানো বৃন্দাবনচন্দ্রের মূর্তি পান। সে মূর্তি তিনি
বাড়ি নিয়ে গেলেন। তবে তো ঠাকুর হয়ে গেলেন বণিকের। কিন্তু ধনের থেকে বিদ্যার আর
ভক্তির স্থান বরাবরই উঁচুতে। অতএব ঠকুর ওই ব্রাহ্মণকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন- বাবা
আমার ভক্ত আছে নদীর ওই পাড়ে। তার নাম সত্যদেব সরস্বতী। আমায় তার কাছে দিয়ে এসো।
ব্রাহ্মণ রাজী নয়। সে বলে তোমার অভাব কি? আরাম আয়েশ আর আরো ঘনঘটা করে পুজোর
ব্যবস্থা করে দিচ্ছি বরং। সত্যদেব একটা
চালচুলোহীন সন্ন্যাসী, তার কাছে তুমি পাবেটা কি? কিন্তু ভগবানও নাছোড়। পুনঃ পুনঃ
তিনি ব্রাহ্মণের স্বপ্নে আবির্ভূত হতে লাগলেন, সঙ্গে সেই একই নির্দেশ- আমায় ওই
সত্যদেবের কাছে দিয়ে এসো। শেষে রেগেমেগে ব্রাহ্মণ বৃন্দাবনচন্দ্রকে শান্তিপুরেই
রেখে চলে গেলেন বৈকুণ্ঠে। বৃন্দাবনচন্দ্র এক বিধবা ব্রাহ্মণের ঘরে পুজো পেতে
লাগলেন। এদিকে সত্যদেবও স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে এলেন শান্তিপুরে। সেই বিধবার কাছ থেকে
দক্ষিণা হিসেবে বৃন্দবনচন্দ্রের মূর্তিটিকে নিয়ে এলেন গুপ্তিপাড়ার নির্জন বেতবনে
সন্ন্যাসীর কুটীরে।
একদিন বিশ্বেশ্বর নামে বৈদ্যবংশের এক অর্থবান
নিঃসন্তান ভুস্বামী দেবমূর্তির অনিন্দ্যরূপে মুগ্ধ হয়ে জমি দান করলেন মন্দির
প্রতিষ্ঠাকল্পে। ১৬০২ খ্রীষ্টাব্দে মন্দির নির্মান শুরু হল আর শেষ হল ১৬১২
খ্রীষ্ঠাব্দে। ‘চৈতন্যদেব মন্দির’ নামে সেই জোড়বাংলা মন্দিরটি আজও দাঁড়িয়ে আছে এক কাঠচাঁপা
গাছের শীতল ছায়ার নিচে।যদিও তার গায়ের অলংকরণ আর নেই। তবু দুচারটি সাদা ফুল
ভোরবেলায় আজও পড়ে থাকে দেবতার চরণ পাবে বলে। আর বৃন্দাবনচন্দ্রের পরিবর্তে এখানে রয়েছে শ্রীচৈতন্যদেবের
মুর্তি।
বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দির
কৃষ্ণচন্দ্র
মন্দির তৈরী নিয়ে আছে আরেক গল্প। কাগজে কলমে তো ঠকুর বৃন্দাবনচন্দ্র অনেক ভূসম্পত্তির
মালিক হলেন। কিন্তু ভগবানের
বিষয়বুদ্ধি কম। তাই খাজনা বাকি পড়ে নবাব আলিবর্দি খাঁর কাছে। ডাক পড়ে
বৃন্দবনচন্দ্রের। হাজিরা দিতে হবে নবাবের দরবারে। কিন্তু নবাব বিধর্মী। তাঁর
দরবারে বৃন্দাবনচন্দ্র যান কি করে? জাত যায় যে। আবার নবাবের তলব। না গেলেও রক্ষা
নেই। দণ্ডীস্বামী পীতাম্বরানন্দ আর সব ভক্তেরা মিলে ঠিক করলেন একটি নকল
বৃন্দাবনচন্দ্রের মূর্তি তৈরী করা হোক আর সেই মূর্তিই পাঠানো হোক সুলতানের দরবারে।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। তা সেই নকল
মূর্তি যখন যাচ্ছে মুর্শিদাবাদে সুলতানের দরবারে, তখন কৃষ্ণনগরের রাজার মধ্যস্থতায়
এক চুক্তি হল। নকল বৃন্দাবনচন্দ্রকে হাজিরা দিতে হলনা আর, বরং তাঁর ঠাঁই হল
কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরে। এই বিরাট আটচালা মন্দিরের গায়ের কারুকার্যও এখন আর তেমন
অবশিষ্ট নেই।
কৃষ্ণচন্দ্র
মন্দিরের ঠিক মুখোমুখি রয়েছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় টেরাকোটার কারুকার্যমণ্ডিত রামচন্দ্র
মন্দির। বাংলা একরত্ন শ্রেণীর মন্দিরের ভিতরে আছে রাম সীতা আর লক্ষণের মূর্তি। মন্দিরের গা টেরাকোটার
আল্পনার মত নকশা আর নানা কাহিনীচিত্রে সাজানো। ১৮১২ থেকে ১৮২২ খ্রী এই দশ বছরে
দণ্ডীস্বামী কেশবানন্দের আমলে তৈরী এই অপূর্ব মন্দির। শোনা যায় শেওড়াফুলির রাজা
হরিশচন্দ্র রায় মন্দিরটি তৈরী করান। মোট এই চারটি মন্দির নিয়ে উঁচু আয়তক্ষেত্রাকার
পাঁচিল ঘেরা জায়গাটিই বিখ্যাত গুপ্তিপাড়া মঠ। রথযাত্রা শুরু হয় এই মঠ থেকেই।
রামচন্দ্র মন্দির
কলমীর বিছানা পটলের বালিশ
রথযাত্রার
প্রস্তুতি থেকে শুরু করতে হলে প্রথমেই স্নানযাত্রার কথা বলতে হয়। স্নানযাত্রার
শুরু জৈষ্ঠ শুক্ল পূর্ণিমার দুপুরে। মঠের উত্তর-পশ্চিম কোণে উঁচু দেয়াল ঘেঁষেই আছে একটা দোতলা
ঘর। যার নিচতলায় একটা দরজা আর
উপরের তলাটা যেন একটা ছোট মঞ্চ, যার চারদিকই খোলা। মঞ্চে রয়েছে টিনের পাতে মোড়া
একটা কাঠের চৌকি। উপরের তলায় ওঠার সিঁড়ি বাইরে মঠের বাগান থেকে শুরু হয়ে সরাসরি
উঠে গেছে দোতলায়। স্নানযাত্রার দিন দুপুরে
জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রার মুর্তি এইখানে এনে ১০৮ ঘড়া জলে স্নান করানো হয়।
গুপ্তিপাড়াবাসীর কাছে এই স্নানজল অতি পবিত্র। কেউ কেউ শান্তিবারি হিসেবে মাথায়
নেন, কেউ সংগ্রহ করে নিয়ে যান। একটি লেখায় পড়লাম কেউ কেউ মনে করেন এর ওষধিগুণ আছে। পান করলে রোগ সারে।
কিন্তু এই ঘড়া ঘড়া জলে স্নান করে জগন্নাথদেব নিজেই জ্বরে কাবু হয়ে পড়েন। তখন তিনি
কলমী শাকের বিছানায় পটলের বালিশ মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়েন। আর ওঠেন সেই রথযাত্রার
আগে। এই দিন থেকে গুপ্তিপাড়ার মানুষ কলমী শাক আর পটল খাওয়া বন্ধ করেন। আবার অনেকে
বলেন জগন্নাথ দেবের এই জ্বর আসাটা নিছক গল্প। বরং অত্যধিক জল ঢালার ফলে তাঁর গায়ের
রং সব চটে যায়, এরকম রং চটা অবস্থায় তিনি বেরোবেন কি করে? তাই নতুন করে রং করতে ও
তা শুকোতে যা সময় লাগে সেই সময়টিতেই তিনি থাকেন গৃহবন্দী হয়ে।
নেত্রোৎসব আর তার পরের দিন
এইভাবে ১৫ দিন গত
হলে আষাঢ়ী শুক্লা প্রতিপদে পূজা আর হোমের মধ্যে দিয়ে শ্রীজগন্নাথদেব নবকলেবরে
বেরিয়ে আসেন। একে বলে নবযৌবন বা নেত্রোৎসব। তার পরদিন শুক্লা দ্বিতীয়ায় রথযাত্রা। সেদিন একেবারে ভোরে প্রথম ব্যান্ডেল
থেকে কাটোয়া লোকালেই পৌঁছে গেছি গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবচন্দ্র মঠে। সেই আমার প্রথম গুপ্তিপাড়া
মঠ দর্শন। সেদিনের শিশিরে ভেজা কচি ঘাসের উপর দাঁড়িয়ে বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দির থেকে
ভেসে আসা কীর্তনের আওয়াজে যে মুগ্ধতা অনুভব করেছিলাম তা আজও অমলিন। মন্দিরের ভিতরে মালা
গাঁথছেন মহিলারা। এক সদ্য গোঁফ গজানো কিশোরবয়স্ক ঠাকুরমশায় মন্ত্র পড়ে চলেছেন কচি
গলায়। পাটভাঙ্গা শাড়ি পরে কাঁসার থালায় ঠাকুরের বাসন আর ভোগ নিয়ে আসছেন মহিলারা।
মনে হচ্ছে অতীতযানে চড়ে যেন পেরিয়ে এসেছি কয়েকশ বছর, আর পুরোনো সেদিনের
ব্রথযাত্রার অনুষ্ঠান যেন অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে আজকের আমার সামনে।
“রথের সাজনি দেখি লোকে
চমৎকার।
সব হেমময় রথ সুমেরু
আকার।।
শত শত সুচামর দর্পণ
উজ্জ্বল।
উপরে পতাকা তার চাঁদোয়া
নির্মল।।
ঘাঘর কিঙ্কিনী বাজে
ঘণ্টার ক্কণিত।
নানা চিত্র পট্টবস্ত্রে
রথ বিভূষিত।।”
গুপ্তিপাড়ার রথ বাংলার সর্ববৃহৎ কাঠের রথ। তবে
আজ যে রথ আমরা দেখি সেটা প্রাচীন রথটি নয়। সম্ভবত ১৭৪৫ খ্রীঃ নবাব আলিবর্দী খাঁর
সময়ে, গুপ্তিপাড়া মঠের নবম দণ্ডীস্বামী পীতাম্বরানন্দ আশ্রমের আমলে এই রথযাত্রা
শুরু হয়। তখন নীলাচলে রথযাত্রা দেখতে যাওয়া ছিল রীতিমত অভিযান। দস্যুর আক্রমণে,
রোগের প্রকোপে, পথশ্রমে কত তীর্থযাত্রীর যে প্রাণনাশ হত! এইসব বিবেচনা করে গুপ্তিপাড়ায়
রথযাত্রার আয়োজন করা স্থির হয়। আর এই সময়েই বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দিরে প্রতিষ্ঠা হয়
জগন্নাথ-বলরাম্-সুভদ্রার দারুমূর্তি। এখন সারাবছর রথটি গুপ্তিপাড়া মঠের উত্তর দিকে প্রাচীরের বাইরে টিনের ছাউনির
ভিতরে রাখা থাকে। রথের সময়ে ছাউনি খুলে ফেলা হয়। আদিতে রথটি ছিল তেরো চূড়ার অতি
বিশালাকার। রথের মাঝের তলায় দেবতার চারপাশে তখন বসানো হত নানা রকম কাঠের পুতুল।
তাদের মধ্যে আছে কলসী কাঁখে নারী, মাছ কুটছে মেছুনী, ঢোলক বাজাচ্ছে বৃহন্নলা,
শিশুকে স্তন্যদান করছে মা, রয়েছে ইঁট ছুঁড়ছে ডাকাতেরা, আর তাদের শায়েস্তা করার
জন্য পুলিশেরা। বারবার রথের কাঠামো সংষ্কার আর পরিবর্তন হলেও সেই শুরুর সময় থেকে
একই রকম রয়ে গেছে এই পুতুলেরা আর তাদের মধ্যে দিয়ে তখনকার সমাজের একটা প্রতিচ্ছবি আজও
অটূট হয়ে আছে রথের গায়ে, আর এইসব মূর্তির কারিগর হিসেবে অমর হয়ে আছেন পূর্ব
সাতগাছিয়ার ক্ষুদিরাম পাল। স্বভাবতই এই রথের সঙ্গে পুরীর রথের তুলনা চলে আসে। দুটি রথের আকারের
তুলনামূলক একটা বিবরণ দিয়েছেন নৃসিংহপ্রসাদ ভট্টাচার্য তাঁর ‘গুপ্তিপাড়ার ইতিহাস
সহ বঙ্গ সংষ্কৃতির এক পর্ব’ বইতে। সে বিবরণ তুলে দিই-
পুরীর রত্থ-দৈর্ঘ্যে
৩২ফুট, প্রস্থে ৩২ফুট, উচ্চতায় ৫২ফুট ৬ইঞ্চি, চাকার সংখ্যা ১৬, চাকার ব্যাস ৭ফুট
গুপ্তিপাড়ার রথ- দৈর্ঘ্যে
১৮ফুট সাড়ে ৬ইঞ্চি, প্রস্থে ২৮ফুট সাড়ে ৬ইঞ্চি, উচ্চতায় ৫১ফুট, চাকার সংখ্যা ১৬, চাকার
ব্যাস ৫ফুট ৩ইঞ্চি
এই তুলনায়
গুপ্তিপাড়ার যে রথটির মাপ দেওয়া হয়েছে সেটি নয় চূড়ার রথ। তেরো চূড়া থেকে কমে গিয়ে
রথটি নয় চূড়া হয়ে যাওয়ার পিছনে একটা মর্মান্তিক কারণ আছে। ১৮৭৩ সালে (বাংলার
১২৮০সন)উলটো রথের দিন চলন্ত রথের চাকার
তলায় পিষ্ট হয়ে ৭ জন পুণ্যার্থী মারা যান। স্বয়ং মঠাধ্যক্ষ তেইশতম দণ্ডীস্বামী
পৃত্থ্বানন্দ মহারাজও গুরুতর জখম হয়ে কিছুদিনের মধ্যেই পরলোকগমন করেন। এর পরেই
রথের আকার ছোট করার সিদ্ধান্ত নেন এই ঘটনার অন্যতম প্রত্যক্ষ্যদর্শী দণ্ডীস্বামী
পূর্ণানন্দ মহারাজ। ১৮৭৮ সালে রথটি আবার তৈরী হলে তা আকারে আয়তনে ছোট করে দেওয়া
হয়। তবুও তখন মাহেশ বা মহিষাদলের রথ এর থেকে অনেক ছোট আকারের ছিল। আজও রথ চলার
সময়ে মাইকে রথের কলেবর ছোট হয়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা হয়- হয়ত এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি
যাতে না হয় সেটাই একবার স্মরণ করিয়ে দেওয়ার অভিপ্রায়ে। এর পরেও কয়েকবার রথটির সংষ্কার হয়। ১৯৫৭ সালে
বন্যায় রথ খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হলে ১৯৫৮ সালে আবার রথ তৈরী হয় মঠের আঠাশতম
দন্ডীস্বামী
খগেন্দ্রনাথ
আশ্রমের তত্বাবধানে আর গুপ্তিপাড়াবাসীর সক্রিয় সাহায্যে। এই নয় চূড়ার রথ ২০১২ সাল
পর্যন্ত সচল ছিল। কিন্তু ১৯৭৮ আর ২০০০সালের বন্যার পরে রথের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ
হয়ে পড়েছিল। তাই এর সংষ্কার জরুরী হয়ে পড়ে। কিন্তু বাধা অনেক। শ্রী সুজিত
মুখোপাধ্যায় বিদ্যারত্নের সঙ্গে দেখা করে এবং তাঁর একটি লেখা-‘ঐতিহ্যময়
গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা’ পড়ে যা জানা গেল তার সারসংক্ষেপ এইরকম- ২০০৮ সালে ২০ জন
সদস্য নিয়ে রথ পুনর্গঠন কমিটি তৈরী হয়। হেরিটেজ কমিশন ও পুরাতত্ব বিভাগে
ছোটাছুটিতে কেটে যায় আরো কয়েক বছর। এরই মধ্যে হেরিটেজ কমিশন জানিয়ে দেয় কোনো সচল
বস্তুতে তাঁরা অনুদান দিতে অপারগ। কিন্তু হাল ছাড়েননি দীপেন্দু ভাদুড়ী, সুব্রত
লাহিড়ী, প্রদ্যুৎ প্রামাণিক ও গোপাল কর্মকার। অবশেষে ২০১০ সালে নবদ্বীপ পুরাতত্ব
পরিষদের তরফ থেকে পশ্চিমবঙ্গ পুরাতত্ব ও প্রত্নতত্ব বিভাগকে মন্দির, রথের পুতুল আর
কাঠামো দেখানো হয়। ২০১১ সালে বিষয়টি নিয়ে খবর করে আনন্দবাজার পত্রিকা। এর পরে
বিডিও সাহেবের উদ্যোগে সমস্ত নথিপত্র আর রথের নকশা নিয়ে আবার সরকারী দপ্তরে দরবার
শুরু হয়। এবার ফল মেলে। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর তহবিল থেকে দশলক্ষ টাকা মঞ্জুর হয়,
উদ্যোগ নেয় তথ্য সংষ্কৃতি দপ্তর। অবশেষে ২৫/০৪/২০১৩ বৃহস্পতিবার নতুন করে রথ
নির্মান শুরু হয়। এই রথই আজ দেখা যায়।
প্রথম টান
রথের দিন দুপুর
বারোটা নাগাদ প্রথম রথটান শুরু হয়। রথে আসীন তিন দেবতাকে উদ্দেশ্য করে থাকে রথের
তিনটি রশি। তার মধ্যে একটি রশি
মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত। রথের পিছনের দিকে থাকে আরেকটি কাছি যেটা ব্রেকের কাজ করে।
পিছনের দিকের এই কাছির দায়িত্বে থাকেন সিভিক ভলান্টিয়াররা আর বিশেষ
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কিছু অভিজ্ঞ লোক। ভক্তদের উৎসাহে যদি রথের গতি অতি দ্রুত হয়ে যায়
তবে এঁরা তা সামলান। যাতে রথে পিষ্ট হওয়ার ঘটনা না ঘটে। পুলিশের পক্ষ থেকে
দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন থাকেন রথের উপরে এবং সমস্ত ব্যাপারটা পরিচালনা করেন। বিশেষ
পুজো সমাপনের পরে জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা একে একে কাঁধে চড়ে মঠ থেকে বেরিয়ে রথকে
সাতবার প্রদক্ষিণ করে তবে নিজের নিজের আসনে আসীন হন। রথে ওঠার কায়দাটা দেখবার মত।
একটা লাল শালুর মত নতুন কাপড় দড়ির মত করে দেবতার গলায় ফাঁস দিয়ে রথে তোলা হয়। এরপর রথেই আরেকপ্রস্থ
পূজার্চনা। সামনে কীর্তনের দলের অবিরাম নামগান। এর পরে এক অভিনব জিনিস দেখা যায়,
সেটা হল রথে ঘোড়া সংযোজন। কাঠের তৈরী একটি সাদা ও একটি নীল ঘোড়াকে একে একে এনে
রথের সামনে লাগানো হয়। তাদের মুখে পরিয়ে দেওয়া হয় মোটা মোটা দড়ির লাগাম। সামনের
উত্তেজিত জনতার কাছ থেকে এ খবরও পাওয়া গেল যে শাদা ঘোড়া শান্ত আর নীল ঘোড়া উগ্র
স্বভাবের। ঘোড়া আনা আর তাকে রথে
সংযোজিত করার কাজটি পরম্পরাগত ভাবে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের
উপরেই ন্যস্ত। রথের উপর ঘোড়া দুটির দায়িত্বে থাকেন স্থানীয় সূত্রধর বংশের সারথী।
রথের মেলায়
রথের প্রথম টানের জন্য
ভক্তদের উৎসাহ দেখবার মত। অনেক আগে থেকেই রথের দড়ির কাছাকাছি বলবান পুরুষদের ঈষৎ ধাক্কাধাক্কি
করতে দেখা যায়। যত সময় এগিয়ে আসে ততই বাহুবলের প্রয়োগ বাড়তে থাকলেও সবটাই একটা
খেলার আকারেই সীমাবদ্ধ। রথের রশি একটু ছোঁয়ার
জন্য মর্মস্পর্শী আকুলতাও দেখলাম। দেখলাম ফাঁকা ময়দান একটু একটু করে কেমন ভরে ওঠে কালো কালো মাথায়।
কেমন ভাবে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে প্লাস্টিকের নলের মধ্যে জমানো বরফ নিয়ে
পেপসিওয়ালা, দেখলাম সামান্য একটা বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ বাক্য তৈরী করে
করে কিভাবে ক্রেতার সঙ্গে চালানো যায় সুরেলা দরদাম। চারিদিকে ভ্রাম্যমান বিক্রেতা।
আইসক্রীমের অস্থায়ী গাড়ি, ডাবের জল, ঘোলের শরবত ভুট্টা পোড়া। ততক্ষণে রথের টান শুরু
হয়েছে। পুণ্যার্থীরের পায়ের ধূলায় আকাশ ঘোলাটে। রথের পিছন পিছন গেলে পাবেন শসা
বিক্রেতাকে। সে তার বউ বাচ্চা নিয়ে এসেছে সাইকেল ভ্যানে। বউটি সামলাচ্ছে ঘুগনির
হাঁড়ি, দ্রুত হাতে শসা কেটে দিচ্ছে যুবক স্বামী, তাদের একরত্তি ছেলে সাইকেলের রডে বসে
অবাক হয়ে দেখছে সামনের জনসমুদ্র, জগন্নাথদেব চলে যাচ্ছেন দেশকালীতলা পার হয়ে।
পুরীর রথের পরেই দীর্ঘতম পথ পরিক্রমা করে গুপ্তিপাড়ার রথ। প্রায় দু কিলোমিটারের এই
যাত্রার দুটি পর্ব। প্রথম পর্বটি বারোটা নাগাদ শুরু হয়ে দেশকালীতলা ছাড়িয়ে একটু
এগিয়ে থেমে যায়। খানিক বিশ্রাম নিয়ে আবার বেলা চারটে সাড়ে চারটে নাগাদ শুরু হয়
দ্বিতীয় টান। দ্বিতীয় দফার এ যাত্রায় পথের দুপাশে মেলার যত এগরোল-মোগলাই পরোটা আর
হরেক মাল ২৫ টাকার দোকান। কিছু জিলিপি, গজা আর খোলাসুদ্ধু বাদামভাজাও আছে। এগরোলের
দোকানের পিছনে আছে ফুচকা আর চাটের দোকান তার পরে নানারকম নাগরদোলা। বড়বাজারে গুন্ডিচাবাড়ি
যাওয়ার পথে মোড়ের কাছে আছে রঙীন কাগজের ঘুর্ণি, পুতুল আর আনারসের দোকান। কয়েকটা
স্থায়ী মিষ্টির দোকানও আছে। আছে গুপ্তিপাড়ার বিখ্যাত গুপো সন্দেশ। আরেকটু এগোলে
মাসির বাড়ির পাশে বিক্রি হচ্ছে খাঁচার পাখি। সুজিত মুখোপাধ্যায় বিদ্যারত্ন বলছিলেন
এমাঠে তিনি সার্কাস আসতে দেখেছেন তাঁর ছেলেবেলায়, সে উদ্দীপনার কথা তিনি ভুলতে
পারেন না। আর ছিল মেলা উপলক্ষে ফলফুলের চারাগাছের দোকান, ছিল বেতের জিনিসের
কেনাবেচা। পাওয়া যেত পেকো (টোকার একটি বড় সংস্করণ। অনেকটা কুলোর মত। যা মাথা থেকে
পায়ের গোছ পর্যন্ত বিস্তৃত থাকত। বর্ষায় ফসল রোয়ার সময় বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার
আবশ্যিক উপাদান)। এসব আর নেই, কেনাবেচাও
কমে গেছে অনেক। তবে এখনো স্নানযাত্রার পর থেকে রথযাত্রা শুরুর মাঝে একটি দিন মেলার
ডাক হয়। যেহেতু রথের সড়কের পাশের জমি দেবোত্তর সম্পত্তি, তাই ডাক দেন গুপ্তিপাড়া মঠের
মহারাজ। স্থানীয় দু তিনটি সংগঠনের প্রতিনিধিরা ডাকে অংশগ্রহণ করেন। নিলামের
মাধ্যমে তিন চার লক্ষ টাকায় এক বছরের জন্য অধিকার পান কোনো সংগঠন। রথের সময় ছাড়া
অন্য সময়ে বিরাট পাইকারি সবজি বাজার বসে রথের সড়কের দুপাশে, সেই বিক্রেতাদের থেকে তাঁরা
কিছু আদায় করেন, এছাড়াও রথের সময়ে যাঁরা অস্থায়ী দোকান দেন তাঁরাও কিছু অনুদান
দেন। শুধুমাত্র রথের মেলার জন্য আলাদা করে কোনো ডাক বা নিলাম হয় না।
গুণ্ডিচাবাড়ি
দেবতা কি সত্যিই যান মাসির বাড়ি?
সন্ধ্যায় দেবতা পৌঁছান
গুণ্ডিচাবাড়ি। আমাদের চলিত কথায় মাসির বাড়ি। এই মাসির বাড়ির কাহিনীটা একটু শোনা
যাক- রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের স্ত্রীর নাম গুন্ডিচা। এই ইন্দ্রদ্যুম্ন হলেন তিনি,
যিনি জগন্নাথদেবের মূর্তি তৈরী করিয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রীর অনুরোধ ছিল বছরে একবার
যেন দেবতা তাঁর বাড়িতে অধিষ্ঠিত হন। শোনা যায় তিনি জগন্নাথদেবকে পুত্র হিসেবে
গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। সেই থেকে মাসির বাড়ি আর সে বাড়ির নাম গুণ্ডিচাবাড়ি। কিন্তু সত্যিই কি
জগন্নাথদেব মাসির বাড়ি যান? গল্পটি কি এতটাই নির্দোষ বালকভোগ্য? একটু শ্রী শ্রী
চৈতন্যচরিতামৃতের কাছে যাওয়া যাক। মধ্য খণ্ড চতুর্দশ পরিচ্ছেদে দেখা যাচ্ছে –
“যদ্যপি জগন্নাথ
করে দ্বারিকা বিহার/ সহজ প্রকট করে পরম উদার/ তথাপি বৎসর মধ্যে হয় একবার/ বৃন্দাবন
দেখিবারে উৎকণ্ঠা অপার/ বৃন্দাবন সম হয় এই উপবন/ ইহা দেখিবারে বড় উৎকণ্ঠিত মন/
বাহির হৈতে করে রথযাত্রা ছল/ সুন্দরাচল যায় প্রভু ছাড়ি নীলাচল”
সার কথা হল সারা
বছর দেবতা নৈতিকতার মোড়কে হাঁসফাঁস করলেও বছরে একবার একটু মুক্তির সন্ধানে নীলাচল
ছেড়ে রথ যাত্রার ছল করে যান গুন্ডিচাবাড়ি। সেখানেই গোপীদের সঙ্গে চলে লীলাখেলা।
সেটি তখন হয়ে ওঠে দ্বিতীয় বৃন্দাবন। স্বাভাবিক ভাবেই সেই আদিরসাত্মক খেলায় স্ত্রী
লক্ষীদেবীর প্রবেশ নিষেধ। এবং আরো স্বাভাবিক জগন্নাথদেবের এই সমাজ অননুমোদিত কাজে
তাঁর স্ত্রীর ক্রোধ। অতএব তিনি তাঁর দাসীদের পাঠালেন। দাসীরা জগন্নাথদেবের
অনুচরদের ধরে নিয়ে এল। তারা প্রতিজ্ঞা করল কালকের মধ্যে লক্ষীদেবীর সামনে তারা দেবতাকে
হাজির করবে। এর প্রমাণ আছে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে যেটি আষাঢ়ী শুক্লা পঞ্চমীতে (হোড়া
পঞ্চমী) পুরীতে অনুষ্ঠিত হয়। এরই এক সংষ্করণ দেখা যায় গুপ্তিপাড়ায়। একে ‘সর্ষেপড়া’ বা
‘লক্ষীবিজয়’ বলে। সুজিত মুখোপাধ্যায় বিদ্যারত্নের কাছে যে গল্পটি শুনি, তাতে তিনি
পরিষ্কার বললেন গুপ্তিপাড়ায় জগন্নাথদেব আসলে যান তাঁর সখী পৌর্ণমাসীর বাড়ি।
পৌর্ণমাসী থেকে মাসি। জগন্নাথদেব তো লক্ষীদেবীকে ঘরে রেখে রথে চড়ে গোপিনীদের সঙ্গে
আমোদ আহ্লাদ করতে চলে গেলেন। একদিন দু দিন করে চারদিন গেলে লক্ষীদেবীর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। তিনি লোকলস্কর নিয়ে (গুপ্তিপাড়ায়
বৃন্দাবনচন্দ্র আর কৃষ্ণচন্দ্রকে নিয়ে)বেরিয়ে পড়লেন জগন্নাথদেবকে শায়েস্তা করতে। গুন্ডিচাবাড়িতে এসে
তুকতাকের আশ্রয় নিলেন। মণ্রপুত সর্ষে ছিটিয়ে দিতে লাগলেন গুন্ডিচাবাড়ির চারপাশে
যাতে অতিষ্ট হয়ে বেরিয়ে আসেন দেবতা। গুপ্তিপাড়ায় এখনো এই ‘সর্ষেপড়া’ অনুষ্ঠান
বিরাট করে হয়। মন্ত্রপুত সর্ষে ছিটিয়ে দেওয়া হয় বিগ্রহের দিকে আর সামনে টান্টান
করে ধরে রাখা হয় সাদা কাপড়। বিগ্রহ থেকে ছিটকে এসে পড়া সর্ষে ওই কাপড়ে পড়লে দলে
দলে মহিলারা তা কুড়িয়ে নেওয়ার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে পড়েন এই বিশ্বাসে যে ওই সর্ষে
তাঁদের স্বামী সোহাগিনী করে রাখবে চিরকাল। তবে এই অনুষ্ঠানে প্রমীলাবাহিনীর কাছে
পুরুষ দর্শকেরা নিতান্তই অসহায় বোধ করবেন।
ভাণ্ডার লুঠ
কিন্তু এই
সর্ষেপড়াও বিফল হল। জগন্নাথদেব গোপীনীতে মজে আছেন তো আছেনই। অতএব তাঁকে ভাতে মারার
ব্যবস্থা হল। এইখানে গুপ্তিপাড়ার রথের আরেকটি বিশেষ অনুষ্ঠানের কথা এসে পড়ে, যেটা
গুপ্তিপাড়া ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় না। সেই অনুষ্ঠানের নাম ‘ভাণ্ডার লুঠ’। শ্রী
বিনয় ঘোষ তাঁর ‘পশ্চিমবঙ্গের সংষ্কৃতি’ বইতে অনুমান করেছেন এটা আসলে গুপ্তিপাড়ার
স্থানীয় গোপেদের কোনো অনুষ্ঠান যা পরে রথযাত্রার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এখন ভাণ্ডার
লুঠে যাঁরা অংশ নেন তাঁরা অর্ধেক গোপ আর অর্ধেক অন্যান্য শ্রেণির। ভাণ্ডার লুঠের
কাহিনীটি এরকম- সর্ষেপড়ায় সুবিধা করতে না পেরে লক্ষীদেবী তাঁর বলবান অনুচরদের
পাঠালেন গুণ্ডিচাবাড়ি। উদ্দেশ্য সেখানে জগন্নাথদেব ভালোমন্দ যা খাচ্ছেন সেগুলো লুঠ
করে আনা। যাতে অন্তত পেটের টানে তিনি বাড়ি ফেরেন। সেদিন গুঞ্জাবাড়িতে
(গুন্ডিচাবাড়িকে গুপ্তিপাড়ায় এ নামে ডাকা হয়)সকাল থেকেই খিচুড়ি তরকারি পাঁচরকম
ভাজা, পায়েস রান্না হয়ে থরে থরে মালসা ভর্তি করে রাখা হচ্ছে মাটিতে। বিকেলে বৃন্দাবনচন্দ্র
আর কৃষ্ণচন্দ্রকে দুটি দোলায় চাপিয়ে শোভাযাত্রা করে নিয়ে আসা হল গুণ্ডিচাবাড়িতে।
ততক্ষণে সে বাড়ির তিনটি বন্ধ দরজার সামনে খালিগায়ে চলছে বাহুবলীদের মহড়া।
ধাক্কাধাক্কি ঠেলাঠেলি চলছে। কে আগে ঢুকে লুঠ করতে পারে কত বেশি হাঁড়ি তার জন্য
বাইরেই গুঁতোগুঁতি। চারিদিকে উত্তেজনা। মাইকে অবিরাম ঘোষণা। উৎসাহী দর্শকদের
ঠেকিয়ে রাখার জন্য পুলিশের দড়ির ব্যুহ রচনা। সব আয়োজন সমাপ্ত। বৃন্দাবনচন্দ্র আর
কৃষ্ণচন্দ্রের দোলার সামনে তাঁদের নিজস্ব ব্যান্ড। তার আগে নৃত্যপর মহিলারা। দেবতা
পৌঁছানোমাত্র একসঙ্গে খুলে দেওয়া হল গুণ্ডিচাবাড়ির তিনটি দরজা। হুড়মুড় করে লোক
ঢুকে লুঠ করে নিল সব খাবার ভর্তি মালসা। একেকজন একাধিক হাঁড়ি। এই লড়াইতে ততক্ষণে
তাঁদের সারা শরীরে লেগে গেছে খাবার। এবার বাড়ি ফেরার পথে মালসা নিয়ে যেতে যেতে
তাঁরা পথে বিলিয়ে যান প্রসাদ। রাস্তার দুধারে হাত পেতে পুণ্যার্থী আর খালি গায়ে
খিচুড়ি বিলিয়ে যাচ্ছেন লুঠেরারা। খুব সুন্দর এ দৃশ্য। সব ভোগ বাড়ি নিয়ে যাওয়া নয়,
বিতরণের আনন্দেই লুঠের সার্থকতা।
বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দিরে ফ্রেস্কো
বারবার শৈশবে
এর পরে আর কি। সে
রাত্রে তো জগন্নাথদেবের তেমন কিছুই খাওয়া হয় না। সব খাবার যে নিয়ে গেছে লুঠেরারা।
অতএব পরদিন মানে মানে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসো। সেদিন উলটো রথ। আবার লোকে লোকারণ্য,
কারণ দক্ষিণটানেই যে বেশি পুণ্য। আর এ্ত লোকের ভিড়ে হয়ত আজও সেই দুটি বালক আছে
যাদের খুশি, যাদের দুঃখ এই মেলাটিকে করুণ-রঙীন করে তুলছে। বহু বছর পর তাদের বুড়ো
বয়সে হয়ত আবার কোনোদিন তারা এ মেলায় এসে তাদের কান্নাহাসির শৈশবের কথা মনে করবে। আমি নিশ্চিত যতদিন তারা
যথেষ্ট বুড়ো না হচ্ছে ততদিন চলবেই এ রথ।
ঋণঃ-
সুজিত
মুখোপাধ্যায় বিদ্যারত্ন – গুপ্তিপাড়া
অসীম হালদার-
গ্রন্থাগারিক, শিশিরবাণী পাঠাগার/গুপ্তিপাড়া
শুভ্র নন্দী- সিজা/খামারগাছী
যাঁদের লেখা থেকে
টুকে দিয়েছিঃ-
পশ্চিমবঙ্গের
সংষ্কৃতি- বিনয় ঘোষ
নৃসিংহপ্রসাদ
ভট্টাচার্য ‘গুপ্তিপাড়ার ইতিহাস সহ বঙ্গ সংষ্কৃতির এক পর্ব’
সুজিত
মুখোপাধ্যায় বিদ্যারত্ন -‘ঐতিহ্যময় গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা’
ড প্রফুল্ল কুমার
পান- গুপ্তিপাড়ায় শ্রী শ্রী বৃন্দাবন জিউ-র আবির্ভাব ও রথযাত্রা
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন