ধোপা বাড়ি

আপনার পাড়ার
গলি দিয়ে মাথায় ঝাঁকা নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন অবাঙ্গালী মহিলা। তাঁর ঝাঁকায় চকচকে স্টীলের
বাসন। ভর দুপুর। সচকিত হয়ে আপনি বাইরে বেরোলেন। ফেরিওয়ালাকে ডাকলেন। আলমারী থেকে বেরোলো
ন্যাপথালিনের গন্ধওয়ালা কবেকার শাড়ি। একদিন হয়ত প্রিয় ছিল আপনার। কিন্তু কবে শেষ পরেছিলেন
তা ভুলে গেছেন একেবারেই। মোটকথা ওই শাড়ি নিয়ে কোনো স্মৃতিই আপনার আর অবশিষ্ট নেই। অথবা
শাড়িটি কেউ উপহার দিয়েছিল, কিন্তু আপনার পছন্দ হয়নি মোটে, আবার ফেলেও দিতে পারেন নি
প্রাণে ধরে। আজ সময় এসেছে, সেইসব স্মৃতিহীন অস্বস্তিকর আর নতুন শাড়ি কেনার প্রতিবন্ধক
শাড়িগুলোকে বিদায় দেওয়ার। ফেরিওয়ালাকে দিয়ে দিলেন তেমন কয়েকটি আর তার বদলে নিলেন স্টীলের
থালা, বাটি বা টিফিন কৌটো। আপনার আলমারী খালি হল আর রান্নাঘর ভরে উঠল। কিন্তু আপনার
দিয়ে দেওয়া সেই শাড়িগুলো গেল কোথায়?
আবার, প্রখর
গরমে এসপ্ল্যানেড চত্বরে হাঁটছেন, ক্লান্ত ঘর্মাক্ত হয়ে গ্র্যান্ড হোটেলের সামনে ছায়া
ঘেরা জায়গায় এসে দেখলেন ঝকঝকে সাদা নিষ্কলঙ্ক
জামা হাতে ফেরিওয়ালা হাঁকছে একশো টাকা একশো টাকা, আপনি জানেন ওইসব জামা মরা সাহেবের,
কিন্তু সেই জামা পরলে এই গরমে কী শীতলতার অনুভবই না হবে এই ভেবে কিনে ফেললেন একটা দুটো।
কিন্তু মরা সাহেবের জামার সাহেবী ময়লা গন্ধ ঘুচিয়ে কে সেটাকে শ্রমিকের জামা বানালো?
বা কোন প্রক্রিয়ায় সেই সাদা জামায় শ্রমিক কিছুটা হলেও সাহেব হল?
এসব জানতে গেলে
আপনাকে আসতে হবে ঝাড়খন্ডে। আসানসোল থেকে যে রেল লাইন চলে গেছে ধানবাদের দিকে সেটা দিয়ে
গমগম করে যখন ট্রেন চলে যায় বরাকর নদীর ব্রীজের
উপর দিয়ে তখন নীচে তাকালে দেখবেন বরাকরের হলদে বালির চরের উপরে কেউ যেন এঁকে দিয়েছে
হরেক রঙের চৌখুপি। অপ্সরা প্যাস্টেলের চৌষট্টি শেডের রঙ থই পাবে না সেই বর্ণচ্ছটার
কাছে। চৌখুপি সেই রঙবাক্সের ফাঁক দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নদীর সরু জলরেখা, আরো ভালো করে লক্ষ্য
করলে দেখবেন ছোট্ট কয়েকটি বাচ্চা হাঁ করে তাকিয়ে আছে অপসৃয়মান ট্রেনের দিকে। আরো আরো
ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখবেন ওই রঙীন চৌখুপি গুলো শাড়ি আর তার গায়ে জরি চুমকি লাগানো
কাজের উপর ভোরের সূর্যের আলো পড়ে ঝিকমিক করছে।
অশোক রজক বলছিলেন
এ হল দ্বিতীয় সুরাট। সুরাটে নতুন কাপড় তৈরির কল, আর এখানে পুরোনো কাপড় তিলে তিলে হয়ে
ওঠে নতুন। একদিন সাহস করে বরাকর নদীর উঁচু ব্রীজ থেকে নেমে পড়লাম নিচে। ব্রীজের উপরের
রাস্তার মত নদীর বুকও সমান কর্মব্যস্ত। জলের কিনারায় পাথরে চলছে কাপড় আছড়ানোর কাজ।
একসঙ্গে ছ সাতটি কাপড় পেঁচিয়ে ধরে বেশ কয়েক বার আছড়ে তাকে নদীর জলে ডুবিয়ে ফের আছড়ানো।
বারকয়েক এইরকম চলার পর শেষবারের মত ধুয়ে সাইকেলে
চাপিয়ে কাপড় নিয়ে যাওয়া হল বালির চরে। তারপর
ধোয়া কাপড় নির্দিষ্ট দুরত্বে টানটান করে পেতে শুকাতে দেওয়া হল। এর মধ্যেই নদীতে চলছে
স্নানপর্ব। একেকটা ট্রেন চলে যাচ্ছে উপর দিয়ে, শোনা যাচ্ছে তার গুরুগম্ভীর আওয়াজ। নদীর
পাড়ে চিতার মত জ্বলছে কাঁচা কয়লা। শুকিয়ে ওঠা শাড়ি ইস্তিরি হবে, তারপর চলে যাবে মহাজনের
ঘরে।
ফাল্গুন মাস,
হাওয়ায় বৈরাগ্যের ছোঁয়া, আর গাছে গাছে আসক্তির
পলাশ-শিমূল। দোল এসে যাচ্ছে। বরাকরের ব্রীজের উপর থেকে দেখলে তার বৈচিত্রহীন শুকনো
বালিতেই দেখা যায় প্রতিদিনের হোলি। রঙ-বেরঙের
আবির যেন ভোরবেলা কেউ ছড়িয়ে দিয়ে যায় আবার দুপুর বারোটায় স্নান সেরে সাফসুতরো
হয়ে সেই আগের নদী। সকালের কর্মব্যস্ত নদীর ধার ভালো লেগে গেল, আর সেই বালকের সঙ্গ,
যে টেনে নিয়ে যেতে চাইছিল রেল ব্রীজের উপরে, সেখান থেকে নাকি ভালো ছবি পাওয়া যায়। উপর
থেকে তাদের নদীর চর স্বর্গ। সে স্বর্গ দেখাতে চায়। এরপর যতবারই যাই ছেলেটির সতর্ক নজর
এড়াতে পারিনা কোনোদিনই। ‘আবার তুমি এসেছ?’ এই প্রশ্নে বুঝতে পারি সঠিক জায়গাতেই এসেছি।
দুশোরও বেশি
ধোপা নদীর ধারে তাদের ঘর বানিয়েছেন। টালির চাল, মাটির দেওয়াল। সেই দেওয়ালের রঙও অতি
উজ্জ্বল নীল বা সবুজ। ধোপাদের সংখ্যাগরিষ্ট অংশ হিন্দু, তাদের পদবী রজক। কিছু মুসলিম
ধোপাও আছেন। প্রায় সকলেই হিন্দিভাষী। আছে কিছু বাঙ্গালীও। রজক পল্লীর শুরুতেই তাদের
বাড়ি। এখানকার সবচেয়ে পুরোনো বাসিন্দা তাঁরা। তাঁদের আছে দালান কোঠা, বাড়ির সামনের
রাস্তা পাকা। পাশেই উঁচু শাটার দেওয়া দোকান ঘর, তার মধ্যে ডাঁই করে রাখা পুরোনো কাপড়,
সেগুলো দেওয়া হবে ধোপাদের। কাচার পর মহাজন পাট করা কাপড় নিয়ে যাবে বিক্রির জন্য। এই
ভাবে রাস্তা দিয়ে যত নদীর দিকে এগোবেন চোখে পড়বে মাটির বাড়ি, বড় অশ্বত্থ গাছ, অলস মোষ
জাবর কাটছে। নিকোনো উঠোনেও জড়ো করা কাপড়।
সন্ত কবীরের
একটি বিখ্যাত ভজন প্রায়ই শোনা যায়, তাতে কবীর বলছেন ঈশ্বরের কাছ থেকে তিনি যে দেহরূপ
চাদর পেয়েছেন তা অবিকৃত অবস্থায় ঈশ্বরকেই ফিরিয়ে দিচ্ছেন। কেবল মূর্খ লোক চাদর নোংরা
করে। আমরা অধম আমাদের ধোপার আশ্রয় নিতে হয়। অশোক রজকের স্ত্রী বারবার তাকে অনুরোধ করছিলেন
আমাকে অন্তত একটা বসার চেয়ার দেওয়ার জন্য। অতিথি দাঁড়িয়ে থাকলে পাপ। অশোকের দুই ছেলে
এক মেয়ে, বড় ছেলে জুনিয়ার ইঞ্জিনিয়ার। প্রথম সন্তান মেয়ে। সে ও পলিটেকনিক পাশ করেছে।
তবুও সব কিছুর ফাঁকে ফাঁকে মায়ের সঙ্গে সঙ্গে কাপড় মেলে দেওয়া, ভাঁজ করার কাজে সে হাত
লাগায়। যার যত লোকবল এই কাজে তার তত বেশি আয়। অশোক তাঁর আয়ে সন্তষ্ট। বেশি নেই, তবু
ইচ্ছেমত কাজ নেওয়া বা ছেড়ে দেওয়ার স্বাধীনতা যে এ পেশায় আছে সে কথা বলার সময়ে মুখ উজ্জ্বল
হয়ে ওঠে তাঁর। প্রতিদিন প্রায় পঞ্চাশ হাজার শাড়ি ধোওয়া হয় এখানে। একেকজন দুশো করে শাড়ি তৈরী করতে পারেন দিনে। চাইলে আরো বেশি করা সম্ভব।
তার জন্য দরকার লোকবল। এখানে তাই সন্তানাদি একেই সীমাবদ্ধ নয়।
অশোকের বাড়ির
পাশেই ধুলোয় গুলি খেলছে বাচ্চারা। অন্ধকার ঘরে কাপড় ইস্ত্রী করার ছবি তুলতে হচ্ছে।
সাত আটটি কাচা কাপড় ভাঁজ করে একটার উপরে আরেকটা রেখে গোটাটাই ভিজে গামছায় মুড়িয়ে ইস্ত্রী
করা হয় দুহাতে। দুহাতেই থাকে ভারী দুটো লোহার ইস্ত্রী। সেখান থেকে এক খেলুড়ে বাচ্চা
বাইরে টেনে এনে নীল আকাশের দিকে দেখালো। সেদিক আলো করে আছে লাল শিমূল। কয়েকদিন আগেও
যখন এসেছিলাম এই গাছটা লক্ষ্য করিনি, আসলে ফুল তখনো ফোটেনি। সেদিন নদীর চরে কাপড়ও খুব
কম ছিল। দোকানে চা খেতে খেতে শুনলাম স্ট্রাইক চলছে। রজকেরা স্ট্রাইক করেছে মজুরি বাড়ানোর
দাবিতে। কাপড় প্রতি মহাজন ওঁদের দেন পাঁচ টাকা। কাপড় কাচার কেমিক্যাল, কয়লা ঘুঁটে শ্রম
সব ঐ পাঁচ টাকার মধ্যে। রজকরা চান ওটা ছ টাকা হোক। আজ একটু আগেই শুনেছি মহজন কিছুটা
হলেও দাবি মেনেছেন। প্রতি কাপড়ের রেট ধার্য হয়েছে সাড়ে পাঁচ টাকা। মাঝামাঝি রফা। তবে
নয়া রেট কার্যকারী হবে পয়লা মার্চ থেকে। বাচ্চাটা বলল ওই শিমূলের ছবি তোলো। কেমন রক্তলাল
-
রক্ত বেরিয়েছিল
দুর্গা রজকের মুখ থেকে। কাপড় কাচা তারপর থেকে বন্ধ। তবে খুব অসুবিধা হয়নি। দুর্গার
মেয়ে চাকরি পেয়েছে জামালপুরে রেলে। তার কষ্ট কমেছে। জামাই ট্রান্সফার নিয়ে আসতে চায়
চিত্তরঞ্জন রেল কারখানায়। বদলি হয়ে এলে আমি যেন দেখি। পাশের বাড়ি থেকে এক মহিলা মুখ
বাড়িয়ে বললেন এত তো লেখেন, আমরা যে সাড়ে পাঁচ টাকায় সন্তুষ্ট নই লিখে দেবেন সেটা্ও।
এই টাকায় এত কষ্ট পোষায়, দেখলেন তো সব? যে রাস্তা নদীর বুক চিরে অন্য পারে চলে গেছে।
তার উল্টো দিকে দুর্গার আরেক মেয়ের বাড়ি। দুর্গা দুপুরের খাবারটা ওই মেয়ের বাড়িতেই
খান।
অশোক বলছিলেন
হতে পারে আমি ধোপা, কিন্তু ছেলেদের পড়িয়েছি প্রাইভেট স্কুলে। কোনো যেমন তেমন সরকারী
স্কুলে নয়। ছেলেরা আশোকের লক্ষীসরাই এর বাড়িতে যান কিনা জিজ্ঞাসা করা হয়নি। লক্ষীসরাই
তেই তো অশোকের আসল বাড়ি, বিশ বছর আগে সেই বাড়ি ছেড়ে এই ধোবিখানায় এসেছিলেন অশোক। একে
একে এনেছেন তাঁর ভাইদের। ভায়েরা আগে অশোকের মতই কাপড় কাচতেন, এখন আর কাচেন না। কাচা
কাপড় বিক্রি করেন মহাজনের থেকে নিয়ে। অশোক তবু দেশে যান, ধান খেত মাঠ, এসব তাঁর ভালো
লাগে। তবু ছেলেদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে প্রতিদিন পরিষ্কার কাচা ধবধবে সাদা গেঞ্জি গায়ে
তিনি অন্ধকার ঘরে ঢুকে যান, যে ঘরে অপেক্ষা করছে বস্তা বস্তা মরা মেম দের শাড়ি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন