এক্তেশ্বরে গাজনের মেলা
মধ্যযাম।
পঞ্চমী তিথি শুরু হয়েছে রাত দশটা উনচল্লিশ মিনিটে। আকাশে পূর্ণ চন্দ্র। দ্বারকেশ্বরের
বুকে শুকনো বালিমাটি মেশানো জনশূণ্য চর হা হা করছে। এইসময়ে নদীতে জল থাকেনা
কোনোবছরই। কিন্তু এমন রিক্ত, এমন শূণ্য কখনো মনে হয়নি নদীটাকে। দুঃখভঞ্জন দাঁড়িয়ে
আছেন মূল মন্দিরে প্রবেশ পথের ডানপাশে। এখান থেকে তাঁর দৃষ্টি নদী পর্যন্ত যায় না।
সামনে বড় গাছের জঙ্গল কালো হয়ে জমাট বেঁধে আছে, সেখানে জোনাকির অসংখ্য হলদে আলো
জ্বলছে নিবছে। গ্রামে জন্ম হলেও এত জোনাকি কস্মিনকালে দেখেন নি দুঃখভঞ্জন। যেমন
স্মৃতি হাতড়ে হাতড়ে পঞ্চাশ বছর পিছনে গিয়েও মনে পড়ল না চৈত্র সংক্রান্তিতে এ
মন্দির কখনো ভক্তশূন্য দেখেছেন তিনি। বাঁকুড়া জেলার বিখ্যাত মন্দির এক্তেশ্বরে
প্রতিবার তিনিই হন প্রধান ভক্তা। কতলোক তাঁকে প্রণাম করে। মহিলারা তাঁর আদুড় গায়ে
মাখিয়ে দেয় হলুদ। জলে ভেজা বেল পাতায়, বেলের গন্ধে হলুদে সিঁদুরে মাখামাখি হয়ে
মন্দিরের বাইরে তিনি যেন আরেক শিব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁর পাশে মন্দিরের নিরেট
পাথরের দেওয়ালে পদ্মের পাপড়ির মত বাঁক গুলোর একটায় গাজনের কাঠের পাটা হেলিয়ে রেখে
তিনি নিরন্তর বিলিয়ে যান আশীর্বাদ। প্রখর সূর্যালোক তখন যেন সামনের অশ্বত্থ গাছের
পাতা বেয়ে ঠান্ডা চাঁদের বাঁকানো আকার নিয়েই মাটিতে এসে পড়ে। সেরকমই শীতল। আজও দুঃখভঞ্জন
প্রধান ভক্তা, কিন্তু আজ অন্য ভক্তারা নেই কেউ। সেই হলুদ মাখানো মেয়েগুলিই বা
কোথায়? কোথায় সেই বেল পাতার গন্ধ? তার বদলে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে হাজার বছরের
পুরোনো এক নিঃসঙ্গ মন্দির। সে মন্দির এখন নতুন রঙে রাঙানো, উপরন্তু জ্যোৎস্নার
আলোয় মাখামাখি হয়ে তা যেন আরো স্নিগ্ধ। কিন্তু দুঃখভঞ্জনের ভয় করে মন্দিরের ভিতরে
ঢুকতে। গৌরীপট্ট ভেদ করা শিবলিঙ্গের যে ছবি আমাদের চোখে ভেসে ওঠে এ মূর্তি তেমন
নয়। লম্বাটে, অনেকটা যেন মাটিতে শোয়ানো লাঙ্গলের ফলা। তার উপরে মন্দিরের দরজা দিয়ে
প্রবেশ করলেই এক গর্তের মুখ। সিঁড়ি দিয়ে বেশ খানিকটা গভীরে নেমে দেখা মেলে দেবতার।
দেবসেবা করতে গিয়ে আজ যেন তাঁর মনে হয় ওই গর্ত দিয়ে তলিয়ে যাচ্ছেন হাজার বছর
অতীতে। শিবায়ন কাব্যের কথা শুনেছেন দুঃখভঞ্জন। সৃষ্টির জন্ম থেকে শিবঠাকুরের
জীবনের গোটাটাই সেখানে বর্ণনা করা হয়েছে। জ্যোৎস্নায় দাঁড়িয়ে থেকে তিনি যেন
পৃথিবীর সেই আদিকালে ফিরে গেলেন।
এক আশ্চর্য মন্দির এই এক্তেশ্বর। মন্দিরের দেবতার
নাম এক্তেশ্বর। মন্দির যে গ্রামে তারও নাম এক্তেশ্বর। লোকে জানে এক্তেশ্বর হলেন
শিবঠাকুর। কিন্তু এই শিবঠকুর যে মন্দিরে আছেন পুরাতাত্বিক আর ঐতিহাসিকরা সন্দেহ
করেছেন সে মন্দির আসলে জৈন বা বৌদ্ধদের। এমন মন্দির নাকি গোটা বাংলায় নেই। আর
বাংলার সব মন্দির যে রীতিতে তৈরী তার সঙ্গে এর গঠন শৈলীর কোনোই মিল নেই। উপরন্তু
মন্দিরটা অনেকবার সংষ্কার হওয়ায় এর আদিরূপের খানিক পরিবর্তনও হয়েছে। বিশেষতঃ
মন্দিরের শিখর ভেঙ্গে যাওয়ায় সেটা অসম্পূর্ণ অবস্থাতেই রয়েছে আজও। শুধু মন্দিরের
গায়ে ছোট ছোট দেউলের যে মন্ডিত রূপ আছে তা দেখে কিছুটা আন্দাজ করা যায় কেমন ছিল
চূড়ার আকার। এ মন্দিরের বয়স হাজার ছাড়িয়েছে আর তার দক্ষিণ দিকে বয়ে গেছে
দ্বারকেশ্বর নদী। দুঃখভঞ্জন মন্দিরের গা বেয়ে দৃষ্টি উপরে প্রসারিত করতে থাকেন।
পঁয়তাল্লিশ ফুট উঁচু নিরেট ল্যাটেরাইট পাথরের মন্দিরের হঠাৎ ভোঁতা হয়ে যাওয়া চূড়ায়
গিয়ে তিনি যেন হারিয়ে গেলেন চাঁদের আলোর শাদা গভীর ফেনায়, কেউ যেন অকস্মাৎ তাঁকে
ঠেলে ফেলে দিল ওই সমুদ্রে।
এই পুকুর থেকে প্রতিবছর গাজনের পাটা নিয়ে আসেন
দুঃখভঞ্জন। চাঁদের আলোর সাদা ফেনা পেরিয়ে তিনি সেই পুকুরটাকেই যেন আবার নতুন করে
দেখলেন আজ। কালো জলের উপর টিপপানার ঝাঁক। চঁদের আলোয় পানার পাতার সবুজ রঙ স্পষ্ট
বোঝা যাচ্ছে। একটা মেছো মাকড়সা তার পিছনের পা দুটো পানার পাতায় আটকে সামনের তিন
জোড়া পা জলের উপর ছড়িয়ে শিকারের অপেক্ষায় আছে। তার একটা পা জলের নিটোল উপরিতলে ছোট
টোল ফেলেছে। এসব কি দেখছেন দুঃখভঞ্জন? কোনো চৈত্রে তিনি এমন দেখেন নি। জল থেকে
পাটা আনার রাজকীয়তায় সব দেখা হয়ে ওঠেনি তবে। আজ দুঃখভঞ্জন একা। কাঠের পাটায় গাঁথা
কবেকার বড় বড় পেরেক গুলো আজ তাঁর মুখের সামনে তীক্ষ্ণ হয়ে উঁচিয়ে আছে। এ সবই তো
প্রতীক। সেই গাজন বন্ধ হয়ে গেছে কবে, সেই কাঁটা ঝাঁপ, শালের চড়কের গাছে ঝুলে পাক
খাওয়া ভক্তা, সন্ন্যাসীর খেউড় ১৮৬৫ সালে ছোটলাট বিডন সাহেব আইন করে বন্ধ করে
দিয়েছেন। রয়ে গেছে এই পাটা, আগে এই পাটা জুড়ে বসানো থাকত তীক্ষ্ণ শূল, তার উপর
শুয়ে পড়তেন সন্ন্যাসী। দুঃখভঞ্জন পাটায় লাগানো কবেকার মরচে ধরা লোহার পেরেকে হাত
দেন। যত্নে হাত বোলান পাটার উপরের দিকে প্রদীপের শিখার মত কাঠের টুকরোয় আঁকা ফুলের
নকশার উপর।
দুঃখভঞ্জন ভাবেন, সেভাবে দেখতে গেলে সব সত্যিই তো বহুকাল
পেরিয়ে এসে অবশেষে প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকে। এই যেমন শিবলিঙ্গ। এটা নাকি চাষের
অস্ত্র, আবার এটা নাকি কবরের ফলকও হতে পারে। ভালো রে ভালো, মনে মনে হাসেন
দুঃখভঞ্জন। একেবারে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ধরে দিয়েছে ওই একটা প্রতীক। গাজনের
পাটায় কয়েকটি পেরেকের প্রতীক হয়ে যেমন বেঁচে আছে বিডন সাহেবের আইন। দুঃখভঞ্জন
ভাবতে থাকেন আজ যে অতিমারীর ভয়ে এতদিনের এই গাজন উৎসব বন্ধ হয়ে শুধু একটা প্রতীকের
বোঝা টেনে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি, আজকের সেই অতিমারীটাই আবার কালে কালে কি প্রতীকে পরিণত
হয়!
ছোঁয়াচে করোনা মহামারীর আকার নিতে পারে, গ্রাম কে
গ্রাম উজাড় হয়ে যাওয়ার ভয়ে মানুষ সাবধানে ঘরে দোর দিয়েছে। রাস্তা দেবালয় শুনশান।
নমো নমো করে বাঁকুড়া জেলার সবচেয়ে প্রাচীন এই উৎসব টিঁকিয়ে রাখতে হবে, আর তার
দায়িত্ব একা দুঃখভঞ্জনের। গাজনের পাটা নিয়ে তিনি একাই চলতে লাগলেন। নদীর দিক থেকে
একটা শেয়াল হেলেদুলে রাস্তা পেরিয়ে গেল। জ্যোৎস্নার মিঠে আলোয় মেলাতলা দিয়ে চলতে
চলতে দেখলেন শাঁখারি বসে আছে। প্রতিবছর মেলার সময়ে এই রাস্তার উপরেই সে বসে। মেলা
নেই শাঁখারি আছে। দুঃখভঞ্জন জানেন শিবই শাঁখারি। রামেশ্বরের শিবায়নে আছে শিব নিজে
শাঁখারির বেশে এসেছিলেন উমার অভিমান ভাঙাতে। বলেছিলেন- পরিলে আমার শঙ্খ পতি নাহি
ছাড়ে/ ধনপুত্র লক্ষী হয় পরমায়ু বাড়ে// স্বামীর সুভগা হয় সদা রয় কোলে। পরিহাসে
ভালোবাসে উঠে বৈসে বোলে/ শঙ্খ হাতে থাকিলে সংসারে কারে ভয়/ রোগ শোক সন্তাপ তিলেক
নাহি রয়/ কান্তের সহিত কতকাল থাকে জীয়া/ এমন শঙ্খের গুণ শুধিবে কি দিয়া// দুঃখভঞ্জন দেখতে পেলেন যুগ যুগান্তর পেরিয়ে এই
দুধের মত শুভ্র চন্দ্রালোকে সেই শাঁখারিটি চাঁদের আলোর চেয়েও অমল ধবল অপূর্ব
কারুকার্যমণ্ডিত সব শাঁখা নিয়ে বসে আছে,
পাশে তার মলিন বস্ত্রের পুঁটলি। শাঁখা বাছছেন পার্বতী, সে বাই-শঙ্খের কোনোটার গায়ে
খোদাই করা ব্রহ্মা বিষ্ণু, তার মাঝখানে মহেশ্বর, কোনোটাতে গোপ-গোপী কোনোটাতে পুতনা
বধ কোনোটাতে আবার দামোদর উদুখলে বাঁধা। মনের মত শাঁখা পছন্দ করে শিবানী তার দাম
দিতে চাইলেন। শিব বললেন- ‘অমূল্য শঙ্খের মূল্য আত্ম-সমর্পণ’
দুঃখভঞ্জন এগিয়ে চললেন, রাস্তার দুধারে পসারিদের
স্থায়ী দোকান সবই আজ বন্ধ। ক্রেতা দূরের কথা একজনও বিক্রেতা নেই। চাঁদের আলো ছাড়া
আর আলো নেই। উঁচু রাস্তার অনেক নিচে জমি, অল্প স্বল্প আগাছায় ঢাকা। ধুলোহীন
পরিষ্কার আলোর ভিতর দিয়ে তিনি স্পষ্ট দেখলেন তলোয়ার হাতে লুঙ্গি পরে এগিয়ে আসছে এক
যুবক, তার কাঁধে বোঁচকা। দুঃখভঞ্জন থমকে দাঁড়ালেন। মানুষটি আরো কাছে এলে তিনি
বুঝলেন একে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। প্রতিবছর এ লোকটি মেলায় বঁটি দা লোহার ঝাঁঝরি
খুন্তি বিক্রি করতে আসে। সঙ্গে থাকে মস্ত এক নতুন তলোয়ার। প্রতিবছরই সেটা বিক্রি
হয়ে যায়। পড়ে যাওয়া জমিদার বংশের কেউ বা উঠতি ধনীদের মধ্যে কেউ কেনে। সবই প্রতীকের
মায়া, ভাবলেন দুঃখভঞ্জন। তবে একদিন সত্যি সত্যিই নাকি অস্ত্রের ঝনঝনা শোনা গেছিল
এখানে। লোকে বলে সামন্তভূমের রাজার সঙ্গে মল্লভূম-বিষ্ণুপুরের রাজার বিবাদ হয়েছিল
রাজ্যের সীমানা নিয়ে। এতই গুরুতর সে বিবাদ যে স্বয়ং মহেশ্বরকে উদ্যোগী হতে হয়েছিল
বিবাদভঞ্জনে। নিস্পত্তির পর দুই রাজ্যের জমির সীমানা যেখানে নির্ধারিত হয়েছিল
সেইখানে তৈরী হয়েছিল এক্তেশ্বর মন্দির। পরষ্পরের এক্তিয়ারের অভিভাবক বলেই কি
এক্তেশ্বর নাম? লুঙ্গি পরা তলোয়ার হাতে লোকটা দুঃখভঞ্জনের পাশ দিয়ে অনির্দিষ্ট
ভাবে চলে গেল। এমন ভাবে গেল যেন সে কিছুই দেখছে না। মেলা বসবে না এবছরের মত।
সুতরাং আগে এসে এক্তিয়ার বুঝে নেওয়ার তাগিদ নেই। কোনোদিনই কি এই তলোয়ারওয়ালা ফিরে
আসবে আর? মহামারী চলে গেলে তলোয়ার কি কোনো কাজে লাগবে কারো?
দূরে অনেক গুলো পলুই হাতে দাঁড়িয়ে আছে একজন।
মেলাতলা বড় বড় বৃক্ষলতায় ছাওয়া। বট অশ্বত্থের ঝুরি, তার ফাঁকে ফাঁকে কত রংচঙে
জিনিসের সারি, তেলেভাজা মুড়ি আর জিলিপির গন্ধ। আজ সেইসব বিক্রেতারা কেউ নেই।
কিন্তু একদিন ছিল তারা। প্রাণ ভরে শ্বাস নেন দুঃখভঞ্জন। যেন অতীতের শব্দ গন্ধ
নাকের ভিতর দিয়ে ঢুকিয়ে একবার জিভে বুলিয়ে নিয়ে যান। এ মেলায় অনেক পলুই বিক্রি হত।
কিন্তু এখন পলুই নিয়ে লোকটা একাই দাঁড়িয়ে আছে। যেন কবেকার ছায়ামূর্তি। এবার সে
একটা পলুই একটু উপরে তুলল। ঘুগি,পলুই এসব দিয়ে মাছ ধরে। গরমে পুকুরে বা বড় জলায় জল
যখন হাঁটুর নিচে চলে যায় তখন ওই খাঁচার মত পলুই জলে ফেলে ফেলে আটক করে মাছ ধরা
যায়। পলুই বেচা লোকটা একাই জঙ্গলের শেষে যেখানে মেলার বড় মাঠ শুরু হয়েছে সেখানে
দাঁড়িয়ে আছে। হাওয়া দিচ্ছে, সেই হাওয়ায় মাঠের কিছুটা ধুলো উড়ে গেল। চাঁদের আলো যেন
ওই ধুলোকে আশ্রয় করে পুকুরের ঢেউ এর মত দুলে উঠল। লোকটা অমনি খপ খপ করে দুবার
পলুইটা ওই আলোর ঢেউয়ে বসিয়ে দিল। তার পর উল্টে দেখল। যদি চাঁদের চেয়েও উজ্বল
রূপালী কোনো মাছ ধরা পড়ে। আলোয় ভেসে যাওয়া ওই ময়দানে লোকটা মাছ ধরার খেলায় মেতে
উঠল। পার্বতী একবার বাগদিনীর বেশে মর্তে এসেছেন, শিব তখন মর্ত্যে চাষবাস নিয়ে খুব
ব্যস্ত। ভুলেই গেছেন পার্বতীকে, ভুলেই গেছেন হিমালয়ে তাঁর বাড়ি। মর্ত্যে এসে তিনি
কোঁচিনী পাড়ায় তাদের নিয়েই মেতে আছেন। শিবানী এসেই শিবের ধানের ক্ষেতে মাছ ধরতে
লেগে গেলেন। এতে ধানের প্রভূত ক্ষতি হল। আসল উদ্দেশ্য শিবের মনযোগ আকর্ষণ। “যুক্তি
কর্যা পার্ব্বতী পদ্মারে লয়ে সাথে/ অবতীর্ণ মহামায়া মহেশের ক্ষেতে//” এর পরে হল
কি- “হোগলের বনে পদ্মা লুকাইয়া রয়/ বান্ধ বান্ধ্যা বিধুমুখী সিঁচা ফেলে পয়/ প্রথমে
প্রচুর পুঁটি লম্ফ দিল কাছে/বান্ধ বান্ধ্যা বলিল বিস্তর মৎস্য আছে/ ধরে মৎস্য ধান
ভাঙ্গ্যা করে বরাবর/ ভূম দেখিতে ভীম আস্যে ভণে রামেশ্বর/” দুঃখভঞ্জন চোখ বুজলেন, পলুই
নিয়ে শুকনো মাঠে মাছ ধরার ভঙ্গী করতে করতে লোকটা দূরে যেন শিবলোকে মিলিয়ে গেল।
মন্দিরে পাটা রেখে দুঃখভঞ্জন বাইরে বেরিয়ে আসেন।
যদিও পনেরো দিন তাঁর মন্দিরের ভিতরেই থাকার কথা। এই পনেরো দিন মন্দিরের মূল লোহার
গেট বন্ধ থাকবে, কোনো ভক্তা, কোনো দর্শনার্থী ভেতরে যেতে পারবেনা। আর আসবেই বা কে,
সবাই তো বাইরের লোক। রাস্তায় গাড়িঘোড়া সব বন্ধ। গরম তেমন পড়েনি এবার। নদীর চরে দুটো
চখাচখি বেরিয়ে পড়েছে, সাধারণত বিকেল বেলায় ওরা নদীর চরে ঘুরে ঘুরে পোকা খায়। আজ এই
জ্যোৎস্নায়, শেষরাতে হলুদ চাঁদের দিকে তাকিয়ে কোনো বিকেলের কথা ওদের স্মৃতিতে ভেসে
উঠেছে হয়ত। এ মেলায় অনেক পাখি আসে। তারা চখাচখি নয়। খাঁচায় বন্দী নামি দামি সব
পাখি। তারা চিরকালের বন্দি। সারা রাতের মধ্যেই কেনাবেচা শেষ করে চলে যায়
পাখিওয়ালা। রোদ উঠে গেলে পাখিদের গরম লাগে। মরে যায় তারা। তাই সকালে পড়ে থাকে শুধু
ফেরিওয়ালার সবুজ রবারের পেট টেপা টিয়া। মেলার সময়ে চখাচখি আসতে পারে না, আজও তারা
উড়ে গেল বনের দিকে।
কেউ কেউ ঝিঙে লাগায় এখন। তারাও দ্বিধাগ্রস্ত। চাষ
হবে কি? কোথায় বেচবে? মেলায় অনেক তরমুজ আসে গাড়ি বোঝাই করে। তরমুজের খোসায় সবুজ
ছোপছোপ হয়ে যায় মেলার রাস্তা। একটাও নেই আজ। গাছগুলোর নিচে এতদিনে তাঁবু পড়ে যায়।
খোল, ডুগডুগি বাচ্চাদের ঢোল নিয়ে মহা ধুন্ধুমার লেগে যায়। মোটর সাইকেলের খেলা আসে।
কয়েক দিন আগেই তারা তাঁবুর কয়েকটা কাঠামো রেখে গেছিল, সেগুলো পড়ে আছে। তার একটা
টিনের পাতে আঁকা কয়লার ইঞ্জিনের ছবি। কয়লার ইঞ্জিনে টানা গাড়িতে চেপেছেন
দুঃখভঞ্জন। সে দারুণ মজার। এখনকার মেলার নাগরদোলায় চড়ে বাচ্চাদের মুখের ভাব যেমন
হয় তার মধ্যে নিজের সেই রেলগাড়িতে চড়ার আনন্দ খুঁজে পান দুঃখভঞ্জন। হেসে হেসে তিনি
মাথাটা ঝোঁকালেন। কোমরে বাঁধা ধুতিটা একটা ফাঁস দিয়ে তিনি ঝোলার মত করে রাখেন
সবসময়। সেই ঝোলায় থাকে বাতাসা আর প্রসাদী ফুল। খুব খুশি হলে তিনি সামনের কাউকে সেই
ফুল আর বাতাসা দেন। অভ্যাস বশতঃ কোঁচরে হাত দিয়েই তিনি চমকে উঠলেন। কেউ নেই। কাকে
দেবেন প্রসাদী ফুল।
অনেক দূরে হাইওয়ের থেকে যে মাটির রাস্তা মেলায় ঢুকে
গেছে সেদিক থেকে একজনকে আসতে দেখলেন দুঃখভঞ্জন। খানিকটা খুঁকে পড়েছে সে। তার কাঁধে
মস্ত একটা শাদা বোর্ড। লোকটির পিছনে পিছনে থান পরা এক মহিলাকেও দেখা যাচ্ছে। লোকটা
বন্দুক দিয়ে বেলুন ফাটানোর খেলার দোকান দেয় মেলায়। সঙ্গে আসে ওর বিধবা মা।। মেলায়
ঢোকার অনেকটা আগেই ওরা বসে।। ভারি ভালো লোক। দুঃখভঞ্জন খুশি হন। একজনকে অন্তত
প্রসাদ দেওয়া যাবে। দুজনেই বিপরীত দিক থেকে ক্রমশঃ পরষ্পরের মুখোমুখি হওয়ার জন্য
হাঁটতে থাকেন। দুঃখভঞ্জনের মনে আছে মেলায় একবার এক ফটোগ্রাফার ওদের দুজনের ছবি
তুলেছিল। যথাসম্ভব হাসিমুখে ছবি তোলার পর লোকটা বন্দুক তুলে দিয়েছিল ছবি তুলিয়ের
হাতে। তারপর বলেছিল মারো। তার পিছনে কাগজ সাঁটানো বোর্ডে অসংখ্য গুলির দাগ। কয়েকটা
লাল নীল ফোলানো বেলুন। সামনে দড়িতে ঝোলানো প্লাসটিকের মেয়ে পুতুল। কাকে মারবে
ফোটোগ্রাফার? ওই বেলুন, ঝোলানো পুতুল না হসিমুখের দোকানদার, কাকে? ঘাবড়ে গিয়েছিল
সে। তার দশটা গুলির একটাও লক্ষ্যভেদ করেনি, না পুতুলে না বেলুনে না হাসিমুখে। হয়ত
সে ভেবেছিল ভালোই হল। তারপর পয়সা দিতে গেলে কিছুতেই নিল না বন্দুকওয়ালা। ঘামে
জবজবে প্রশস্তবুক দাঁড়িয়ে রইল অনড় হয়ে। সে তার হাসিমুখের ছবি তুলেছে, কয়েকটা গুলির
বিনিময়ে সেই মূল্য ফিরিয়ে দিতে চায়। তার পিছনে চালচিত্রের মত গুলিতে ক্ষতবিক্ষত
হয়ে যাওয়া একটা বোর্ড, তার সংসার তার বিধবা মা সবাইকে গুলির আড়াল থেকে বাঁচিয়ে সে
বসিয়ে রেখেছে নিচে। দুটো তিনটে বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে তবু সে হাসিমুখেই ছবি
তুলেছিল। এসবের সাক্ষী ছিল দুঃখভঞ্জন। তারও মুখে ছিল ছবি তোলার হাসি। মারী মড়ক
দুর্ভিক্ষ পার করে তারা পৃথিবীর সামনে চিরস্থায়ী করে রাখতে চেয়েছিল তাদের হাসিমুখ,
গুলিবিদ্ধ অতীতের দিকে পিছন ফিরে তারা হাসছিল। বলতে চাইছিল একদিন হয়ত থাকবেনা তারা
তবু তাদের ছবি তোলার হাসি কাল থেকে কালান্তরে সব মানুষের মুখে রয়ে যাবে। দুঃখভঞ্জন
জলদি পা চালালেন। বন্দুকওয়ালাকে দিতে হবে প্রসাদী ফুল আর মিষ্টি বাতাসা।
এক্তেশ্বর মন্দির
দুঃখভঞ্জন সিং
গাজনের পাটার পাশে
মেয়েরা হলুদ মাখিয়ে দিচ্ছে গায়ে
ভক্তার দল
ডুগডুগি নিয়ে
শাঁখারি
তলোয়ার বিক্রেতা
খোল নিয়ে
পলুই নিয়ে যে রৌদ্রকরোজ্জ্বল মাঠে মাছ ধরা দেখাচ্ছিল
ঝুড়ি
খেলার খোল
আসল খোল
প্রথম হাঁটতে শেখা
গাড়ি চড়ার আনন্দে
ট্রেনের মায়া
তরমুজ
আইসক্রিম
পেটে চাপ দিলে আওয়াজ করা পাখি
সেই বন্দুকওয়ালা, ছবি তুলেছি বলে যিনি বেলুন ফাটাতে দিয়ছিলেন। এমনি এমনিই
অপূর্ব লেখা !!!!
উত্তরমুছুনছবিগুলিও বর্ণনার সঙ্গে একবারে মিলেঘুলে একাকার। বড়ো ভালোলাগা তৈরি হলো !!!!