জল্পেশের শিবরাত্রির মেলা/ জলপাইগুড়ি

 


“আসুন বৌদিরা আপনাদের পছন্দের সিন্দুর এই তো আমরাই নিয়ে হাজির হয়েছি প্রশান্তের মহাতীর্থ মা সিন্দুর। কোলকাতার প্রশান্ত ইন্ডাস্ট্রিজের তৈরী যে সিন্দুর যুগ যুগ ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে মা মাসিমাদের কপালে হ্যাঁ সেই মহাতীর্থ মা সিন্দুর, প্রশান্তের মহাতীর্থ মা সিন্দুর চলে এসেছে আপনাদের শহরে। আমরাই নিয়ে হাজির হয়েছি। চার প্যাকেট সিন্দুর, দুই জোড়া সিন্দুরের দাম শুধুমাত্র দশ টাকা দশ টাকা, দশ টাকাতেই আপনি পাচ্ছেন যে কোনো উৎসব অনুষ্ঠানে পুজো পাবনে শুধু একটাই সিন্দুর প্রশান্তের মহাতীর্থ মা সিন্দুর। যে সিন্দুর মায়েদের কপালে দিলেই সত্যি মায়েদের মুখের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে তোলে সেই প্রশান্তের মহাতীর্থ মা সিন্দুর নিয়ে আমরাই হাজির হয়ে গিয়েছি আপনাদের এই শহরে। আসুন বৌদি আসুন নিয়ে যান চার প্যাকেট দুই জোড়া সিন্দুর একত্রে আমাদের কাছে আপনি পাচ্ছেন শুধুমাত্র দশ টাকা দশ টাকা দশ টাকাতেই”। এর পর শ্যামা সঙ্গীত শুরু হয় ‘আমার সাধ না মিটিল আশা না পুরিল’- তখন সন্ধ্যা নেমে আসছে। মহাতীর্থ মা সিন্দুরের ছোট্ট প্লাস্টিক ঘেরা দোকানের পিছনে সবুজ চা-বাগানের উপরে ঢলে পড়ছে সূর্য। চা গাছে ছায়া দেওয়ার ঈষৎ বড় গাছগুলি নিষ্পত্র, তাদের শরীর রুক্ষ। গাছের গায়ে সেই বলিরেখায় পিঁপড়েদের আসা যাওয়া। এই আসা যাওয়ার জগতের কামনা বাসনা সাধ আহ্লাদ পূর্ণ করবেন মহাদেব এই আশায় মেয়ে বউরা লাল পাড় হলদে শাড়ি পরে জরদা নদীর পারে এই জল্পেশের মন্দিরে এসেছেন। প্রশান্তের মহাতীর্থ মা সিন্দুর সেখানে তাদের ডাক দিচ্ছে বাঁশের আগায় টাঙ্গানো সুদীর্ঘ চোঙা ফুঁকে। চোঙার গায়ে লাল কালিতে লেখা ‘ফিলিপস’। কোলকাতার সেই প্রশান্তের সিন্দুর ফিলিপসের চোঙ বেয়ে মায়েদের মুখের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে তুলবে এই আশায় ক্রেতার ভিড়ও অনেক। তারা দোকানের পাশে কাগজের মোড়ক খুলে ফেলে ভিতরের শক্ত কৌটোটি নিয়ে চলে যাচ্ছেন। চা বাগানের পাশে পড়ে থাকা উজ্জ্বল সোনালী মোড়কের স্তুপের উপরে অস্তগামী সূর্যের সোনালী আলো ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে কালোয়।

আজ ২৭ শে ফাল্গুন, ১২ই মার্চ শুক্রবার চতুর্দশী। জন্মে-বৈশ্যবর্ণ রাক্ষস গণ অষ্টোত্তরী ও বিংশোত্তরী রাহুর দশা। মৃতে- দোষ নাই। আগামীকাল অমাবস্যা। আকাশে চাঁদ নেই। তবু সেই চন্দ্রহীন আকাশের থেকে একটা চাপা আলো এসে পড়েছে রেললাইনে। লাইন দুটোর কোনো শেষ নেই। কোথা থেকে এসেছে তা যেমন অনির্দিষ্ট, কোথায় যাবে সেটাও। শুধু একটাই নিশ্চিত যে লাইন দুটো কোথাও মিলবেনা। ট্রেনের কামরায় ঘন অন্ধকার, তারপর জানালার গাঢ় কাঁচ তারপর শুধু ওই দুটি অনন্তে প্রসারিত অত্যুজ্জ্বল ইস্পাতের ফলা। আর কিছু দেখা যায় না। দেখার কিছু নেইও। ট্রেনের কামরায় আমার নিচের বার্থে এক মহিলা কাঁদছেন, তার আক্ষেপ শুধু শোনা যায়। 

পাঁজিতে লেখা ছিল ২৬ শে ফাল্গুন শিবরাত্রি। সেই রাত্রিটি জল্পেশ্বর শিব মন্দিরে কাটানোর অভিপ্রায়ে এসেছিলাম জলপাইগুড়িতে। শিলিগুড়ি বাস স্ট্যান্ড থেকে ময়নাগুড়ির বাসে চেপে ইন্দ্রা (ইন্দিরা) মোড় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের যাত্রা। বাসের রকম ফেরে ঘন্টাখানেকও লেগে যায়। তারপর টোটো ধরে মিনিট দশেক গেলে জল্পেশ। উত্তরবঙ্গে সবচেয়ে বড় আকারে শিবরাত্রির মেলা বসে জল্পেশ্বর শিব মন্দিরকে কেন্দ্র করে। কেউ কেউ বলেন জল্পেশ্বর শিবের নাম থেকেই জলপাইগুড়ি শহরের নাম। কিন্তু যে ভুল হয়েছিল সেটা হল শিবরাত্রির দিন জনসমাগম হলেও জল্পেশের মেলায় মূল ভিড় হয় শিবরাত্রির পরের দিন, যেদিন পাঁজিতে লেখা থাকে ‘গোস্বামী মতে শ্রীশ্রীশিবরাত্রি ব্রত ও পূজা’। এর একটা কারন হয়ত - জল্পেশ মন্দিরের আজকের যে চেহারা তার মূল অবদান কোচবিহারের রাজাদের, তাঁরা প্রথমাবস্থায় শৈব হলেও মহারাজা নরনায়ণের আমলে (১৫৫৪-১৫৮৭)শ্রীশ্রী শঙ্করদেব আসাম থেকে কোচবিহারে এসে দীর্ঘদিন রাজপরিবারের আশ্রয়ে থেকে বৈষ্ণবধর্ম প্রচার করেন। এই সময় থেকেই ধীরে ধীরে জনমানসে বৈষ্ণব প্রভাব ছড়িয়ে পড়তে থাকে। মেলাতেও হয়ত তারই ছাপ পড়েছে।

মুসলমান স্থাপত্যরীতির বিশাল মন্দিরের পিছনে জরদা নদী। মন্দির থেকে নদীর ধার পর্যন্ত এক কিলোমিটার পায়ে চলা রাস্তার দুধারে একসারি করে দোকান। সেগুলিতে একটি দুটি সাদা আলো থাকলেও দোকানের ছোট পরিসরের বাইরে রাতের অন্ধকারে তারা অসহায়। এই ভাবে ক্ষীণকায় দোকানের সারি নদী পর্যন্ত গিয়ে নদী পেরিয়েই হঠাৎ স্ফীত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে আরো প্রায় কিলোমিটার খানেক ব্যাসে। সেখানে জমজম করছে খাবারের দোকান, মাংসভাত মোগলাই। তাদের আছে খদ্দের ডেকে আনার জন্য ভাড়া করা বিশেষ লোক। মেলার মূল মোটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানুষজনকে ক্রমাগত প্রলুব্ধ করছে তারা খাবারের বর্ণনায়, খদ্দেরকে হাত ধরে নিয়ে বসাচ্ছে সাদার উপর লাল বর্ডার দেওয়া ঢাকা বসানো প্লাসটিকের চেয়ারে। সামনের সাদা টেবিলে বেড়ে দিচ্ছে মাংসভাত। 

আর নদীর অপর পারে, আলো যেখানে ক্ষীণ, যেখানে অমাবস্যার আগের দিনের কালোয় ঝিমিয়ে পড়েছে চা বাগান, সেখানে তাদের সমস্ত শোকতাপ নিয়ে জ্বলে জ্বলে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটি দুটি জোনাকি। দু একটি ঝিঁঝিঁ পোকা এই আলোর আয়োজনকে তুচ্ছ করার অভিপ্রায়ে রোজকার মত ডেকে উঠেছে তারস্বরে, তারপর হঠাৎ আজ যে মেলা সেটা বুঝতে পেরে থমকে থমকে যাচ্ছে, সেখানে জমে উঠেছে লটারির খেলা। দর্শকদের মধ্যে টিকিট বিক্রি শুরু করার আগে উঁচু গোল মঞ্চে উঠে দাঁড়িয়েছে একজন হিজরা। বোঝার উপায় নেই যে সে মেয়ে নয়। ফিনফিনে বেগুনী শাড়ি, উঁচু হয়ে ওঠা বুক, ফিতে দেওয়া ব্লাউজ, মসৃন পেটের নিচে নিখুঁত গোল নাভিতে পুরোদস্তুর মোহময়ী হয়ে নেচে নেচে খদ্দের ডাকছে সে। মাত্র দশ টাকার লটারীতে একটি স্মার্ট টিভি জেতার সুবর্ন সুযোগ, এ ছাড়াও আছে সাইকেল স্টিলের বালতি প্লাস্টিকের মগ গৃহস্থালীর নানা জিনিস। প্রকান্ড উঁচু বক্সে গান বেজে উঠলে হিজরা নাচ আরম্ভ করল। অমনি মাইকে ঘোষণা শুরু হল আসুন আসুন, যেন শোনা গেল – মাংসভাত মাংসভাত।

নদীর এই পারে ওইটুকুই উল্লাসের বুদবুদ। ফিরে আসার সময়ে ট্রেনের বার্থে শুয়ে ঘুমের ঘোরে মনের মধ্যে ফুলে ওঠা মেলার সেই বুদবুদে যেন পিন ফুটিয়ে দিলেন নিচে শুয়ে থাকা মহিলা। ট্রেনে ওঠার সময় থেকে তাঁর কামিজের ফাঁকে স্তনসন্ধিতে অতিপ্রকট ভাবে গুঁজে রাখা মোবাইলটি এখন তাঁর হাতে। কামরার সমস্ত আলো নেবানো। শুধু করিডোরের সামান্য একটি নীল আলোয় দেখা যায় সাদা মৃত কাপড়ের টুকরো ঝুলে আছে। মহিলা কথা বলছেন, আজ তাঁর শেষ বোঝাপড়া স্বামীর সঙ্গে। যে সম্পর্ক তিনি টেনে নিয়ে চলেছেন এতদিন, কাল সকালে তার অবসানের আগে সেই ভুল সম্পর্কের প্রতি এই তাঁর শেষ অনুযোগ, এই তাঁর শেষ হাহাকার। যেন গোটা জীবনের সমস্ত ভুল অনুরাগ থেকে আজকের হাহাকারে পৌঁছানোর বৃত্তান্ত মেলে ধরার জন্য তাঁর হাতে পড়ে আছে এই সামান্য কয়েক ঘন্টা। সেই সময়টুকুতে মৃত সম্পর্কের কবরের উপর তিনি ছড়িয়ে দিতে চান কয়েকটি রজনীগন্ধা। পঞ্জিকায় লেখা আছে আজ জন্মে রাক্ষসগণ কিন্তু মৃতে দোষ নাই।

আজ রাতে নাচঘরের তাঁবুর পর্দা ইচ্ছে করেই আধখোলা রাখা হয়েছে। তাঁবুর ভিতরে উজ্জ্বল লাল নীল সাদা আলো। ক্ষণে ক্ষণে সেই আলোর রঙ বদলাচ্ছে। আর বাইরে অসংখ্য উৎসাহী মুখ উদ্গ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে ওই আধখোলা তাঁবুর ভিতরে, চোখ দিয়ে শুষে নিতে চাইছে ভিতরের তাবৎ উত্তেজনা। অল্প উঁচু মঞ্চে পাঁচটি চেয়ারে পাঁচজন অতি স্বল্পবসনা যুবতী। তাঁবুর বাইরে উৎসুক জনতা তাদের কাছে যেন কিছু নয়, যেন ওইসব লুব্ধ চোখ এই তাঁবুরই নিরেট লৌহস্তম্ভ অথবা দড়িদড়া, এইভাবে যুবতীরা পরস্পরের সঙ্গে কৌতুকে মত্ত। আর কিছুক্ষন পরেই শুরু হবে নাচ। প্রথম দিনের প্রথম শো। মাত্র তিরিশ টাকায় যে উত্তেজক নৃত্য দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা আছে ওই ওরাই তার কুশীলব। চোখ দিয়ে জবাই করার আগে তাদের উরু পশ্চাৎদ্দেশ বক্ষ ও বাহুর পরিমাপের জন্য যথেষ্ট সময় দেওয়া জরুরী। তাই তাঁবু আধ খোলা, মাইকে ঘোষনা- তিরিশ টাকার বিনিময়ে দেখুন চিত্রহার। কিন্তু তাঁবুর ভেতরে প্রবেশের পর ধৈর্যহীন কামনার উত্তেজনায় চেয়ার ভাঙলেই দিতে হবে দশ হাজার টাকা জরিমানা। উল্লাসের চাপা শব্দের মধ্যেই শুরু হল চিত্রহার। প্রথম দুটি নাচে তাঁবুর পর্দা খোলা ছিল। তারপর টিকিটহীন বাইরের দর্শকের মুখের উপরে পড়ে গেল পর্দা। ভিতরে আরেকটি খেলা। নানা কথার মারপ্যাঁচে দর্শককে ধৈর্যের চরম সীমায় নিয়ে আসার পরেই শুরু হল একটি নাচ, তারপরে আবার নানান অছিলায় অপেক্ষা করিয়ে রাখা, তারপর আরেকটি।

দর্শক অধৈর্যে উত্তেজিত হয়ে সিটি বাজায়, গালি দেয়। তারপর শান্তিবারি ছেটানোর মত একেকটি নাচ হয়। কিন্তু সংসার শুধু ওই কামেই ভোলে না, তার মন আছে। ট্রেনের দুলুনিতে সাদা মৃতের চাদরটি মহিলার গা থেকে খসে একটু নিচে ঝুলে পড়ে। যে আশা নিয়ে তিনি একদিন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন তাঁর প্রেমিকের হাত ধরে, সে ঝুটো সাব্যস্ত হয়েছে। তার শরীর নেই মন নেই উপার্জন নেই। একটা গভীর নেই এর ভিতর থেকে মহিলা মুক্তি চান। কিন্তু তা কি সহজ সম্ভব? উত্তর তাঁর নিজের কাছেও নেই। রেল লাইনের অতি উজ্জ্বল পাত দুটি দ্রুত পিছলে যা্‌য় সময়ের মত। পিছনে মেলা থেকে ক্ষীণ স্বরে ডাক দেয় প্রশান্তের মহাতীর্থ মা সিন্দুর, ইস্পাতের পাত দুটি কিন্তু সেসব শোনে না। কোথাও মিলিত হয় না তারা। 

অথচ সকাল বেলায় সুখী সংসারের ছবি দেখা যায়। দাদু মেলায় এসেছেন নাতনীকে নিয়ে। সে মায়ের মত চুড়ি পরতে চায়। দোকানী মহিলা খুব যত্নে বাচ্চা মেয়েটির হাত ধরে পরিয়ে দিলেন কাঁচের চুড়ি, তাঁর মুখ দেখে মনে হল যেন তিনি নিজের হাতে নিজেই পরে নিচ্ছেন ফেলে আসা শৈশব। বিরাট মন্দির চত্বরে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্লাস্টিকের বেলুন ওয়ালা। রঙীন মুরগি থেকে হাসিমুখের নক্সা করা সব রকমের বেলুন আছে তার কাছে। যাতায়াতের রাস্তার মধ্যিখানে পঙ্গু ভিখারী শুয়ে আছে। পাশে নগন্য ঠেলাগাড়ি। পথের দুপাশেও ভিখারী, তাদের দান করার জন্য মুড়ি মুড়কির দোকান। ঠোঙায় ভরা রাশি রাশি সেসব পুণ্য দশটাকা করে কিনে ছড়িয়ে ছড়িয়ে চলে যাওয়া যায় একটা গোটা জীবনের শেষপ্রান্ত অবধি। মন্দির চত্বরের একটি গাছে গৈরিক ফুল ফুটেছে। নিচে বাঘছাল পরে আর ছাইভষ্ম মেখে শিব সেজে ঘু্রে বেড়াচ্ছে বহুরূপী। মাইকে গান বেজে উঠলে তালে তালে নৃত্য করে নিচ্ছে সে নটরাজ। গত রাত্রির মেলার কলুষমাখা আহবান তার গায়ে লেগে নেই।

মন্দিরের প্রসারিত চাতালের ওই গেরুয়া ফুলের গাছটির কান্ড ঘিরে চাওয়া পাওয়ার লাল-হলুদ সুতোর আলিঙ্গন। চিরস্থায়ী সুতোর বন্ধনে বেঁধে ফেলার আগে মহিলারা তাদের সুডৌল বাহু দিয়ে ঘিরে ধরছেন গাছটিকে। সে বড় কোমল দৃশ্য। পেলব হাতের শঁখায়-পলায় সংসার সুখের ফেনা উপচে পড়ছে, কয়েকটি কচি হাতও সেই ভিড়ে নজরে পড়ল। নজরে পড়ল ভবিষ্যতের সুখের সাদা শাঁখায় তাদের অবশ্যম্ভাবী ঢলে থাকা। প্রশান্তের মহাতীর্থ মা সিন্দুরের বিজ্ঞাপনের মত দুএকটি গেরুয়া ফুলের রোঁয়া খসে পড়ল মেঘহীন আকাশ থেকে।

মন্দিরের দক্ষিণে বড় পুষ্করিনী। নাম অমৃতকুন্ড। শিবরাত্রির ভালো দিনে কচি বাচ্চাদের চুল দান করে সেখানে স্নান করানোর প্রথা আছে। এজন্য অবশ্য পাঁচশো টাকা দিতে হয় বাচ্চার অভিভাবকদের। তার থেকে দুশো টাকা পান সেই পুরোহিত যিনি দান করা চুলগুলিকে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করেন। তিনশো টাকা যায় মন্দির উন্নয়নকল্পে। নাপিতের জন্য বাকি থাকে না কিছু। নাপিতদের অনুযোগ তাঁরাই তো সবচেয়ে কঠিন কাজটি করেন। শিশুর নরম ত্বককে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত রেখে পুরো ব্যাপারটা সম্পাদন করা কি সহজ? তারপর আছে কেশকর্তনে অনিচ্ছুক শিশুকে ভোলানোর মত হ্যাপা। অথচ তাদেরই কিনা নিশ্চিত আয় থেকে বঞ্চিত হয়ে অভিভবকদের দয়ার দানের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। আর অনিচ্ছুক দাতার থেকে পয়সা উপার্জন কতই কঠিন তা বলা বাহুল্য।

শিশুর মাথার চুলগুলি কলার খোলায় জমিয়ে যেখানে পুজোর জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তার পাশেই বট গাছের নিচে সাধুর আখড়া। এখানে কয়েকটা পাথরের মূর্তি আছে, অনুমান করা হয় পালযুগে তৈরী সেসব। স্কন্দ পুরাণে রাজা জল্পের নাম আছে। চারুচন্দ্র সান্যাল মনে করেছেন জল্পেশ তাঁর পূজ্য দেবতা। তাঁর এও মত উনিশ শকে মন্দিরটি প্রথম তৈরী হয়। আবার গিরিজাশঙ্কর রায় মত প্রকাশ করেছেন জল্পেশ অলৌকিক ক্ষমতাধর কোনো রাজবংশী প্রতাপশালী ক্ষত্রিয় রাজাও হতে পারেন, প্রতিপত্তি বলে পুজো পেতে পেতে আজ এই রূপে এসেছেন। তবে কোচবিহারের মহারাজা প্রাণনারায়ণ (১৬২৫-১৬৬৫) ও মহারাজা মোদনারায়ণের (১৬৬৫-১৬৮০) সময়েই আজকের এইরকম মন্দির তৈরী হয় মুসলমান স্থপতিদের হাতে। তাঁদের পৃষ্ঠপোষনায় আজ জল্পেশের মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়েছে। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মন্দির ভেঙ্গেও যায়। আবারও তৈরী হয় সাধারন মানুষের দানে ও মন্দির কমিটির ব্যবস্থাপনায়। মন্দিরের থেকে অল্প দূরত্বে আছে ভৈরবী মহাদেবী সিদ্ধেশ্বরীর মন্দির।

গাঁজাপাতা কলা আর একঘটি জলের অর্ঘ নিয়ে মেয়েরা বাবার মাথায় ঢালতে চলেছে। মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশের জন্য টিকিট কাটতে হয়। ভিড় এড়িয়ে দ্রুত দর্শনের উপায় আছে। অবশ্যই অর্থের বিনিময়ে। মন্দিরের ভিতরে বড় বাঁধানো গৌরীপট্টের মধ্যে শিব অবস্থান করছেন। রেলিং দিয়ে ঘেরা গৌরী পট্টের বাইরে থেকে তাঁকে দেখা যায় না। গর্তটি শুধু দুধে আলতা জলে পরিপূর্ণ।মন্দিরের ভিতরের দেয়ালে কোনো অলঙ্করন নেই।

১৭১৫ সাল থেকে ১৫০ বছর জল্পেশ অঞ্চল ভুটানরাজের অধীনে ছিল। বহুদিন পর্যন্ত এই মেলায় ভুটানি জিনিসেরও বেচাকেনা ছিল। এখন আর আলাদা করে সেসব নেই। কিন্তু কয়েকটা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জিনিস আছে। তার মধ্যে একটি হল বড় বড় লোহার ট্রাঙ্ক। আরেকটি চিঁড়ে কোটার কাঠের যন্ত্র, কয়েকটি খোলের দোকান, আর পানের উপর রাখা আধখানা কাঁচা সুপারি। আরেকটা জিনিস নজরে পড়ল, সেটা হল মাটির তৈরী পয়সা জমাবার নানা আকৃতির ভাঁড়। এমনকি গ্যাসের সিলিন্ডারের আকৃতির ভাঁড়ও আছে। রান্নার গ্যাসের ক্রমবর্ধমান দাম কে স্মরণ করিয়ে দেওয়া আর তার জন্য মাসের প্রথম থেকে সঞ্চয় করার কথা গৃহস্থকে মনে করায় এই ভাঁড়।

এইভাবে বাংলার মেলা গৃহস্থের মেলা। চালচুলোহীন বাউন্ডুলে লোক মেলায় বেড়াতে আসে না। কি কিনবে সে মেলায়? যেদিকে তাকাও শুধু আরো ভালো করে সংসার করার উপকরণ ছড়ানো। রাস্তায় বহুরূপী কালীঠাকুর সেজে দাঁড়িয়ে আছে, তার পায়ে লুটিয়ে পড়ছে মহিলারা, শুধু সংসার ভালো হোক এই কামনায়। বহুরূপীর গলায় প্লাসটিকের জবার মালা, হাতে কাঠের খড়গ আর ভাষাহীন রক্তমাখা জিভ শুধু আজকের জন্যই ভক্তের ভাষায় কথা বলে উঠছে নীরবে। সে ভাষা বুঝছেন না এমন মানুষ নেই। চারিদিকে শুধু মায়ায় জড়ানোর উপাদান। ভালোবাসার নারীটির ফু্লটুসি ব্যাগ, চুলের ক্লিপ, পুরুষের অদ্ভুত রঙ্গীন চশমা, ফুলবাগান করার খুরপি, কাস্তে কোদাল, ছেলেপুলে হয়ে গেলে তাদের ভোলানোর ব্যাঙ কটকটি, রঙ্গীন পুতুল, আর ভবিষ্যতের আশায় পয়সা জমানোর ভাঁড়। আর কিছু ফল-ফুলের চারা। বাড়ির একচিলতে বাগানে মেলা থেকে কেনা ডালিম গাছে ডালিম ধরাবে গৃহস্থ, বৃদ্ধ বয়সে সেই ফল স্ত্রীর ভালোবাসা হয়ে শুয়ে থাকবে তার মাথার কাছের রেকাবিতে। জীবন তো এইটুকু আশার, এই অক্ষয় সংসারের আশাতেই তো শিবের মন্দিরে হত্যে দেওয়া।

তবু সকল গৃহ হারালো যাদের তারাও আছে কোথাও এ সংসারে, মেলার ভীড়ে। হিজরার নাচের তালে কেউ কেউ ডাকছে একটু পিছলে যাওয়ার ডাক। প্রশান্তের মহাতীর্থ মা সিন্দুর যাদের কপালে উঠবেনা কোনোদিন তাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে একটু পিছলেও যাচ্ছে সংসারী পুরুষ। বেমক্কা কিনে নিচ্ছে দশটাকার একটা লটারির টিকিট, সেটাতে না উঠলে আরেকটা, মাঝের সময়টাতে চোখ রাখছে নাচনেওয়ালীর কোমরে। ধীরে ধীরে বিরহের সুর বেজে উঠছে। ট্রেনের হালকা দুলুনিতে নিচের বার্থের মহিলা তাঁর স্বামীকে বলে চলেছেন। কাল তিনি শ্বশুরবাড়ি পৌঁছাবেন। তাঁদের মধ্যে সব সম্পর্ক যদিও বা শেষ তবু যে কটা দিন তাঁরা একত্রে কাটাবেন সে ক’দিন সুখী দম্পতির অভিনয় করতে হবে ভালো করে, তাঁরা সুখী এই যেন দেখে যান তাঁদের বাবা-মা। তারপর আবার ফিরে যাবেন দুজনে দুজনের আলাদা আলাদা জগতে। মহিলা বলে চলেছেন তুমি তো আমাকে কিছুই দিতে পারলে না, এই সামান্য অনুরোধ রাখো। ট্রেনের শব্দ বেড়ে ওঠে। অনন্তে প্রসারিত ইস্পাতের সমান্তরাল ফলা দুটি চকচক করে ওঠে জানালার ও পারে। প্রশান্তের মহাতীর্থ মা সিন্দুরের বিজ্ঞাপন শেষ করে বেজে ওঠে- আমার সাধ না মিটিল।

জল্পেশ মন্দির


অমৃতকুন্ড

দেবতার অর্ঘ্য


খাঁচায় ভরা পায়রা, উৎসর্গের জন্য


বৃক্ষ দেবতা                                                                          


চুড়ি পরা

জরদা নদী

চিঁড়ে মুড়ি মিঠাই এর দোকান

কুলের আচার

ভাপা পিঠে

কটকটি

প্রশান্তের মহাতীর্থ মা সিন্দুর

লটারীর খেলা

মেলার মূল মঞ্চে লোকগানের আর লোকনৃত্যের আসর চলে সারারাত ব্যাপী

চিত্রহার

চিঁড়ে কোটার কাঠের যন্ত্র

সাধুর আখড়া

ঘোড়ার নাল আর শিকড়বাকড়

মেলার বহুরূপী

কালীঠাকুরের আশীর্বাদ



পান তাম্বুল



মন্তব্যসমূহ

  1. অভিরূপ হলো মহাভারতের সঞ্জয়,ওর সাথে মেলায় ঘুরে বেড়ালাম।মেলা শব্দের অর্থ মিলন ওর লেখা মিলন ঘটায় বাস্তব আর পরাবাস্তবের যাকে ধরি ধরি মনে করি ধরতে যে নাহি পারি,এ যেন মেলার সেই চিত্রহার,বাইরে থেকে উঁকিঝুঁকি একরকম আর প্রবেশ করলে আরেকরকম,মন ছুঁয়ে থাকে সারাক্ষন।

    উত্তরমুছুন
  2. দারুণ লাগলো,মেলা যেন চাক্ষুস করলাম তোর লেখায়,রিঙ্কুদি

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ