জয়চন্ডী পাহাড়ের মেলায়


সেদিন একটি সবুজ বাঘ দেখলাম, গায়ে লাল ডোরাকাটা দাগ। অত্যুজ্জ্বল রৌদ্রে তার ত্বক ঝলমল করছিল। জিরাফেরা শুয়েছিল পাশে। নিহত নয়, বিশ্রামের আলস্যে। অনেক পশুর স্তুপের পিছনে উঁকি দিচ্ছিল পাথরের পাহাড়, তীব্র হলুদ ধুলো। সেই সবুজ বাঘের একটি কান লতিয়ে আছে যেন তাতে সাড় নেই। আরেকটি কান সতর্ক। এসবও কি হয় কোথাও? কোন দেশে আছে এমন সবুজ বাঘ আর হলুদ ধুলো? আমার মাস্টারমশায় সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের একটি লেখা আছে ‘দৈববাণীর সুবর্ণজয়ন্তী’। লেখাটি গুপি গাইন বাঘা বাইন চলচ্চিত্র নিয়ে। সঞ্জয়দা বলছেন ছোটদের জন্য তৈরী এই একটি ছবিতে কোনো গুরুমশায়গিরি নেই। বড়দের মুখের কথা ছোটদের দিয়ে বলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা নেই। এটি রূপকথা নয়, আবার পৃথিবীর কোথাও হাল্লা বা শুন্ডীর মতো কোনো দেশ না থাকলেও, রাজারানীর জমানা কবেই ফুরিয়ে গেলেও শিশুরা এইসব বিশ্বাস করে। এমনকি আমাদের কাছেও যেন এই পরিসরের সবই তত কিছু অবিশ্বাস্য নয়। সেরকম এক বাস্তব ও অবাস্তবের চৌকাঠের উপর শুয়ে থাকতেই পারে সবুজ বাঘ। হলুদ ধুলোয় গড়াগড়ি খেতে পারে জিরাফ আর অজানা পশুপাখি।

শুধু আমাদের ভাবতে হবে এই যুগীঢাল, এই যে প্রায় মসৃণ, মাটির সঙ্গে সমকোণে হঠাৎ উঁচিয়ে থাকা লিঙ্গাকৃতি পাহাড় এটি আদতে আগ্নেয়গিরি। শুধু আমাদের জানতে হবে এখানে পাওয়া গেছে নব্যপ্রস্তর যুগের হাতিয়ার, সেসব চাষবাসের কাজে লাগত। তারপর ওই এখানকার পুকুরে যারা স্নান করছেন, যিনি ঝালমুড়ির টিন নিয়ে ৪৯০ টি সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠে যাচ্ছেন জয়চন্ডী পাহাড়ের মাথায়, পাশে ফেলে রেখে যাচ্ছেন ১৮০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বানানো খবর আদানপ্রদানের গগনস্পর্শী কিন্তু বাতিল টাওয়ার তাঁরা সকলেই যেন আচম্বিতে হয়ে যাবেন চিরসময়ের।

শুধু হাতে হাত মিলিয়ে তালি দেওয়ার অপেক্ষা। এখানে আসতে দরকার হয় শুধু দুটি মানুষের মিলিত ইচ্ছার জোর। তারপর মোটরবাইকের সওয়ারী হয়ে মসৃন পিচরাস্তায় পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর, সেখান থেকে নতুন বাস স্ট্যান্ড হয়ে মাত্রই দু কিলোমিটার দূরের জয়চন্ডী পাহাড়। কখনো এসেছি ছোটদের শৈলারোহণ শেখার শিবিরে কখনো মেলায়। কখনো বা নামিই নি জয়চন্ডী স্টেশনে। ট্রেনে করে চলে গিয়েছি আরো দূরে চাকলতোড়ের ছাতাপরবের মেলায়। কিন্তু  একবারের জন্যেও  জানালার দিয়ে তাকাতে ভুলিনি রেল লাইনের পাশের ওই ভরন্ত পুকুরের দিকে, আশ্বিনে যেখানে ফুটে থাকে লাল শালুক, বাকি জলটুকুতে ছায়া পড়ে উড়ন্ত মেঘের আর চারিদিকে সোনালি ধানের  ওপারে দাঁড়িয়ে থাকে একক নিঃসঙ্গ উদাসী পুরুষের লিঙ্গের মত যুগীঢাল।

যুগীঢালের নিঃসঙ্গতা এখন আর নেই। তার নিচে নীলসাদা বিশাল সরকারী ভবন ‘যুব আবাস’ ও ‘পথসাথী’। যে কেউ ইচ্ছে করলে অনলাইন বুকিং করে কিছুদিন থাকতে পারেন। জয়চন্ডীর নিচে একটি গ্রাম বরাবরই ছিল, কিন্তু তার সাধ্য ছিল না পাহাড়ের মাহাত্ম্যকে খর্ব করে, গ্রামটিরও তেমন ইচ্ছে ছিল না। তার নগন্য মলিন বেশ, তার সংকীর্ণ গলি মহাসম্ভ্রমে শেষ হয়ে যেত পাহাড়ের  গোড়ায়। আর সন্ধ্যেবেলায় সেই পাহাড়েরই ছায়ার বিশাল ডানায় তার নিদ্রার প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হতো। সেই গ্রামে একটি দরিদ্রের পানশালা ছিল। সন্ধ্যার ঝোঁকে সেখানে গিয়ে দেখেছি হঠাৎ করে যেন ভুঁই ফুঁড়ে ঠেলাওয়ালার আগমন। পানশালার সামনে বেশ খানিকটা জমি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। রাত হয়ে গেলে ঠেলাগাড়ির টিমটিমে অপার্থিব আলো ঘিরে সেখানে থাকত অনুপানের খোঁজে  আসা রসিকের ভিড়। ঠেলা থেকে পছন্দমত চাট কিনেই বসে যাওয়া যেত  সেই চত্বরে। রাত গড়িয়ে গেলে চাঁদের আলোয় দেখতাম নিঃসঙ্গ পুরুষ পাহাড়টি কৌতুকের চোখে দেখছে তার পায়ের কাছে রসের  আবেশে গড়িয়ে পড়া মানুষজনকে। বোঝা যেত না কে বেশী একাকী, ঐ পাহাড় না নেশার ঘোরে এলিয়ে পড়া মানুষগুলি।

শহুরে একাকীত্ব গ্রামের মানুষের নেই। ভোর হলেই তারা যুথবদ্ধ ভাবে স্নান করতে যায় পুকুরে, মেলার সময়ে পাহাড়ের নিচের মাঠে নেমে পড়ে পসরা নিয়ে। তখন হলুদ ধুলো ওড়ে মানুষের পায়ে পায়ে, সবুজ বাঘ বেরিয়ে আসে হওয়ায় ফুলে ওঠা শরীর নিয়ে। ইদানীং জয়চন্ডী পাহাড়ের মেলার মাঠে পাকা মঞ্চ তৈরী করে তার নাম রাখা হয়েছে সত্যজিৎ রায় মঞ্চ।  এবছরও সেখানে বসেছে পর্যটন মেলা। কাছেপিঠের গ্রাম থেকে আসা একদল যুবতী জয়চন্ডী পাহাড়ের কঠিন সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে বলে উঠল- সেলফি টো এখুনো হল্য নাই। অবশেষে সেই নিঃস্ব হয়ে যাওয়া প্রকান্ড ইঁটের টাওয়ারের ভিতরে আধো আলোছায়ায় রামধনু রঙিন রোদচশমা পরে ছবি তুলে তারা স্বস্তি পেল। আরেকটু দূরে গিয়ে খেল লেবুর শরবত। কয়েকটি ষাট সত্তরের হাঁটু জবাব দিল পথের মাঝেই। গাছের ছায়ার আরামে খাদের দিকে ঢলে পড়া পাহাড়ের সামান্য পাঁচ-পা জমিতে তারা কাশ্মীরী চাদর জড়িয়ে বসে রইল প্রবহমান সদাচঞ্চল উনিশ-কুড়ির পায়ের দিকে হুতাশের দৃষ্টি নিয়ে। এক বুড়ো তার শেষ সম্বল শ্বাস নিয়ে উঠে যাচ্ছে নাতির হাত ধরে, তুমাকে ছাড়া আমি যাত্যে লারব্য বাপ, ই বয়সে তুমিই তো আমার ভরসা হে। হাতে হাত না মেলালে যে স্বাধীন ইচ্ছেরও বাস্তবায়ন হয় না।

উদয়ন পন্ডিত তার পাথরের খাঁজের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে দেখছে নিচে অবিরাম মানুষের ঢল। বাঘা আঁচাতে গিয়ে দেখে ফেলল পন্ডিতের গোপন আস্তানা, উপর থেকে দেখা যায় মেলার মাঠে দেদার খাবার, টকটকে লাল খোসাওয়ালা বাদাম, মেজাজী হলুদ জিলিপি, বিরাট পুরি, মুড়ি আলুরদম। খেয়েদেয়ে পুকুরের পাড়ের চাপাকলে হাত ধুয়ে নিলেই হল। জয়চন্ডী পাহাড়ের উপর থেকে দেখা যায় ট্রেন লাইন, জয়চণ্ডী স্টেশনের গোল লাল গম্বুজ আর শৈলারোহন শিক্ষার্থীদের অস্থায়ী তাঁবু। উদয়ন পন্ডিত বলল পাহাড়ের ঐ পারে আছে হীরক রাজার দেশ , সে দেশের রাজা ভারী  অত্যাচারী, পন্ডিতের পাঠশালা সে বন্ধ করে দিয়েছে। “হীরক রাজার থেকে অত্যাচারী রাজা আর নেই। বাইরের লোককে সে আসল কথা জানতে দেয় না। সে উন্মাদ, তার ঘাড়ে ভুত চেপেছে। গরীব মানুষ সেখানে না খেয়ে থাকে। যারা বাদ সাধে তাদের জাদু করে বশ করে। তারা মন্ত্রের মত রাজার শেখানো বুলি আউড়ে যায়”

পাহাড়ের ওই পার থেকে মোটরগাড়ি বোঝাই লোক আসে। মেলার মাঠের একদিকে পুকুরের পাড়ে গাড়ির সারি। সুবেশা মহিলা আর সুবেশ পুরুষেরা কাঁধে ব্যাগ নিয়ে একে একে নেমে মেলার মাঠের ভিড়ে মিলিয়ে যায়। তাদের পিছন পিছন দৌড়ে যায় খেজুরপাতা মুড়ে সুন্দর করে তৈরি তোড়া হাতে কমবয়সী ছেলেমেয়ের ঝাঁক। গায়ে তাদের দাদা-দিদির মাপের সোয়েটার, বারবার নেমে যায় কাঁধ থেকে, খুলে খুলে পড়ে হাফ প্যান্ট। তবু তারা সঙ্গ ছাড়ে না। এক হাতে কাঁচা খেজুরপাতায় বোনা অপূর্ব শিল্পকর্ম, আরেক হাতে ছোট ব্যাগে আরো কয়েকটি বাড়তি। একেকটির দাম ২০ টাকা করে । কোনোক্রমে একটি বিক্রি করতে পারলেই আবার ফিরতি পথে দৌড় বাড়ির দিকে, ওরকম আরো খানকতক নিয়ে আসার জন্য। ফিরে আসার সময় একটি মেয়ের সঙ্গে আলাপ হল। তার হাতের শিল্পকর্মটি ছোট। ১৫ টাকায় সে বেচতে চায় সেটি, আর আমি চাই তাকে বিদেয় করতে । মেয়েটিও নাছোড়বান্দা। ঠিক তক্ষুনি সাদা গাড়ি এসে দাঁড়ায়। যেন ধবধবে পক্ষীরাজ। আরোহীদের দুটি তোড়া চাই। তারা মোট তিরিশ টাকা দেবে। আরকটি মেয়ের সঙ্গে দরদাম পাকা হয়ে গেলেও তার কাছে একটিমাত্রই সম্বল। অগত্যা আমার পাশে দাঁড়ানো মেয়েটির হাতের সবেধন নীলমণি তোড়াটির দিকে তাদের নজর পড়ল। আমিও মুক্তির আনন্দে বলে ফেললুম দিয়ে দে না। যা দাম তুই চাইলি ওরা তো সেই দামই দেবে। মেয়েটি রাজী নয়। সে শুধু বলে চলেছে ‘তুমি লাও’। তাকে বোঝালাম শিল্পকর্ম তৈরী করে বাজারে নামার পর তার বিনিময় মূল্যই শিল্পীর একমাত্র লক্ষ্য। এর বাইরে অন্য দিকে নজর দিলে না খেয়ে মরতে হয়। ক্রেতার উপর পক্ষপাত তার কাছে আত্মহত্যার সামিল। মেয়েটি শোনে না। তার একটিই বুলি- ‘তুমি লাও’। গাড়ির আরোহীর অত সময় নেই। আরেকটি বিক্রেতাও অধীর। অবুঝ, খানিকটা ন্যাকা এক শিল্পীর জন্য উপার্জনে অযথা বিলম্ব হচ্ছে। অবশেষে এই ত্রিমুখী আক্রমণের কাছে পরাস্ত হয়ে মেয়েটি হাতের তোড়াটি সমর্পণ করল তার অপছন্দের ক্রেতার হাতেই। লোকটি অন্য মেয়েটিকে টাকা বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেল ধুলো উড়িয়ে। শিল্পী  ফিরেও দেখল না। না টাকার দিকে না ক্রেতার দিকে। আমি তাকে ঠেলে দিলাম মেলার ধূসরতার মধ্যে। ধূলিতে মাথা গুঁজে সে হাঁটতে লাগল যেদিকে হীরক রাজার দেশ। গরীব মানুষ যেখানে না খেয়ে থাকে। যারা বাদ সাধে রাজা তাদের জাদু করে বশ করে। মানুষের স্বাধীনতা যেখানে নেই। তারা মন্ত্রের মত রাজার শেখানো বুলি আউড়ে যায়।  

জয়চন্ডী মন্দির

ঝালমুড়িওয়ালা

ফেরিওয়ালা

নিরালায়

যোগাযোগের বাতিল টাওয়ার

মেলার পথে

খেজুর পাতার শিল্পকর্ম


মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ