লবনধার গ্রামে একদিন

শালজঙ্গল চিরে মোড়গ্রাম পানাগড় হাইওয়ে সোজা চলে যাচ্ছে। এই গরমেও গাছগুলো কি স্নিগ্ধ সবুজ। যেন সদ্যস্নাত। বড় বড় গাড়ি, যেগুলো বয়ে নিয়ে যাচ্ছে পেট্রল, সাঁজোয়া ট্যাঙ্কের খারাপ বেল্ট এইসব গুরুগম্ভীর স্পর্শকাতর জিনিস, তারা ছাড়া বাকি সবাই একবার অন্তত সেই সবুজ বনভূমির কাছে থেমে যেন নমস্কার করছে। সকলেই শুধু জলবিয়োগের জন্য হাইওয়ের ধারে গাড়ি থামায় না, কেউ কেউ আক্ষরিক অর্থে প্রকৃতির ডাকে সাড়াও দেয়। সেই রাস্তায় ত্রিলোকচন্দ্রপুর বাস স্ট্যান্ড মোড় থেকে ডানদিকে বাঁক নিলে ত্রিলোকচন্দ্রপুর ভাতখুন্ডা রোড। তারপর দেবশালা পঞ্চায়েত ভবন। সেখানে প্যান্ডেল করে ধুলোটের আয়োজন হয়েছে। আজ শুক্ল ত্রয়োদশী, 28 শে জ্যৈষ্ঠ, চিঁড়ে মহোৎসব। পানিহাটিতে এক চৈতন্যভক্ত জমিদারপুত্র জনসাধারণকে চিঁড়ের ফলার খাইয়েছিলেন। ঘটনাচক্রে সেই বাঙালি জমিদারপুত্র বৃন্দাবনের ষড় গোস্বামীর একমাত্র অব্রাহ্মণ গোস্বামী। জীবন খুব কঠিন কালীদা। খুব প্যাঁচালো। আশ্চর্য রাজনীতির ওঠাপড়া যেন গায়ে না লাগে, তারজন্য কত চেষ্টায় থাকি সারাজীবন। হায় সেই অলৌকিক বোরোলিন শুধু হোর্ডিংএ থাকে। পানিহাটিতে আজ দুই ভক্ত মারা গেলেন মেলার চাপে ভিড়ে গরমে। খুব মায়া হয়। মানুষ কোথায় যাবে! এইসব চিঁড়ে চ্যাপ্টা মানুষ! এখানেও তারা আছে, এখানেও মাঝে মধ্যে ভয়ঙ্কর খেলা হয়, এই দেবশালা গ্রামে, এই লবনধার গ্রামে। চিঁড়ে চ্যাপ্টা মানুষের রাজনীতি আর ভগবান শ্রীচৈতন্য এখানেও আছেন। আপাতত আমরা সেই রাজনীতি ও ভগবানের মিলেমিশে যাওয়ার স্থানটি ত্যাগ করে আরেকটু এগোবো। আসলে এখন থেকে আরেকটা বাঁক নিয়ে যাবো গুগল ম্যাপে উল্টো করে বসানো রক্ত ফোঁটার গন্তব্যে, পানিহাটি না গিয়ে যে বিন্দুটা আজ মোবাইলে সেট করেছি।

লবনধার গ্রামের নাম প্রথম দেখি ইউটিউবে। সেইথেকে এখানে আসার ইচ্ছে। আজ সাহস করে বেরিয়েছি। তীব্র গরমে হাইওয়ের উপর নকল জলের ইশারা দেখছি বারবার। কেঁপে কেঁপে ওঠা হাওয়া। গাড়ি ধীরে চালাতে হয়, পাছে গরমে ইঞ্জিন জবাব দেয়। বাঁশকোপা টোল পেরিয়ে কিছুটা গিয়ে দিল্লি-কলকাতা হাইওয়ে ছেড়ে দার্জিলিং মোড়ের আগেই এই মোড়গ্রাম-পনাগড় হাইওয়ে। সেখান থেকে আউশগ্রাম দু নম্বর ব্লকের লবনধার গ্রাম।


কথা হল, লবনধারে কি আছে? উত্তর হল একটা গ্রামে যা থাকে। ধানের গোলা, শান বাঁধানো পুকুর,  যার শীতল কালো জলে সাঁঝের আলো ঝলে, যার দুধারে ঘন বন ছায়ায় ঢাকা। সেই 'বধূ' কবিতাটিতে যা যা সব ছিল শহরবন্দী বধূটির গ্রামে, তা সবই আছে এই লবনধারে। একটু দূরের শালজঙ্গল এগিয়ে এসে গ্রামের শেষ প্রান্তের মাটির বাড়িটিকে চুম্বন করছে, মসিকৃষ্ণ সেই মাটির বাড়িটির দেওয়ালে আঁকা আছে একটি শুকনো ডাল। ডালে একটি পাখি তার উন্মুখ পাখনা নিয়ে ওই সবুজ শালের দেশে উড়ে যেতে উদ্যত। কালো দেওয়ালে সাদা রঙে শেষ এই ছবিটি আমাদের মনের সব ইচ্ছার সারাৎসার নিয়েই যেন উড়ে যাচ্ছে বারবার, ওই আদিমতায়।

 
তাই, শুধু একটা গ্রামে যা আছে তাই দেখতেই লবনধারে আসা নয়। এখানে আসার আসল উদ্দেশ্য এই গ্রামের বাড়িগুলির দেয়ালের গায়ে আঁকা ছবিগুলি দেখা। বাড়ির দেওয়ালে আঁকা  ছবি আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। বিশেষত আমরা যারা সাঁওতাল পরগনায় থাকি। আগেই বাড়ির কাছে টাবাডি গ্রামে আশ্চর্য সব দেওয়াল চিত্র দেখেছি। কিন্তু লবনধারের ছবিগুলি আলাদা। এগুলি শহুরে প্রশিক্ষিত লোকের আঁকা। যদিও গ্রামের দৈনন্দিন জীবনকে বিষয় করে অনেক ছবি তাঁরা এঁকেছেন। পশু পাখি এঁকেছেন, জলে ফুটে আছে পদ্মফুল, এইসব, মাছ আছে অনেকগুলো, ময়ূর আছে। কোনোটা স্কেচের মত করে আঁকা, কোনোটা বর্ণিল। সেই বর্ণিল মাছের পেটের ভিতর শুয়ে আছে মানুষ। প্রকৃতির ভিতরে এইভাবেই তো মানুষের থাকার কথা ছিল। তা থেকে আমরা কবেই সরে এসেছি। ছবিটি সেই কথা মনে করায়। যার উদ্যোগে এইসব ছবি আঁকা হয়েছে গ্রামের দেওয়ালে, সেই অর্নব বাবু এখন বোলপুরে কর্মরত। তবুও প্রায় প্ৰতিদিনই গ্রামে আসেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল ছবির মাধ্যমে মানুষকে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করবেন। গাছ কাটতে নিষেধ করবেন, জঙ্গলে অহেতুক আগুন লাগাতে নিষেধ করবেন।
এই উদ্দেশ্যে অর্নব তাঁর পরিচিত কিছু শিল্পীকে জড়ো করলেন। মাত্র তিন দিনের বিরাট উন্মাদনায় গ্রামের মূল রাস্তার পাশের প্রায় সবকটি বাড়িতেই আঁকা হল ছবি। সিমেন্টের দেওয়ালে যেমন আঁকা হল, আদিবাসী বাড়ির মাটির দেওয়ালগুলিও বাদ গেল না। আমার ব্যক্তিগত ভাবে ভালো লাগল মাটির দেওয়ালের ছবিগুলোই।

 
কিন্তু তিন দিন পরে শিল্পীদের সময় ফুরিয়ে গেল। কিছু ছবির স্কেচটিই শুধু দেওয়ালে রয়ে গেল। সময় অভাবে তাতে রঙ ভরা হল না আর। সেই আউটলাইন টুকু করে রাখা ছবিও মাটির দেওয়ালে প্রতীক্ষায় রইল আরেক অনামা শিল্পীর। কোনোদিন সে এসে তার মনের রঙে রাঙিয়ে নেবে সেটি।


কিন্তু লবনধার গ্রামে গেলেই গ্রামবাসীরা আপনাকে প্রথমে দেখাবেন নবনির্মিত একটি অন্নপূর্ণা মন্দির। কারন এই মন্দিরের দেওয়ালে অলঙ্করণ করেই গ্রামে প্রথম দেওয়ালচিত্রের কাজ শুরু হয়।  ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ে পাশের ধর্মরাজ মন্দির তলাতেও। বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন গ্রামের লোক ভক্তা হন। জিভে বান ফোঁড়ান, হাতে বান ফোঁড়ান, ঘটা করে ধর্মরাজের পুজো করেন।


কথা হল কত গ্রামেই তো মাটির দেওয়াল এরকম শূন্য পড়ে থাকে। তাকে কি রাঙিয়ে তোলা যায় না স্থানীয় শিল্পীদের দিয়ে? যায় নিশ্চই। তবে যেখানে আদিবাসীদের নিজস্ব রীতিতে বাড়ির দেওয়ালে ছবি করার রেওয়াজ আছে সেখানে খুব সতর্ক হওয়া জরুরি। আসলে আমরা যতই তাদের বিষয়বস্তু নিই না কেন,তাদের জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে যাইনি বলে ছবিটা তাদের হয়ে ওঠে না।  আবার উল্টো দিকে দেখতে গেলে দেওয়ালের ছবিগুলো দেখাতে গিয়ে গ্রামের মানুষজন যেমন গর্ববোধ করছিলেন তাতে আশা জাগছিল। অনাবিল প্রকৃতির ভিতরে বাস করা মানুষের মধ্যে যে সৌন্দর্যবোধ এমনিতেই আছে তার শিল্পিত প্রকাশ দেখতে দেখতে একদিন তারাও সমস্ত রকম শিল্পবস্তুর প্রতি অনুরাগী হয়ে উঠবেন।  শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠবেন এইটা মনে হচ্ছিল।


অর্নব বাবুর অনুপস্থিতিতে আমাকে অতি যত্নে গোটা গ্রাম ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন মধুসূদন ঘোষ তাঁর দুপুরের বিশ্রামকে হেলায় সরিয়ে।ছবিগুলি দ্বিতীয়বার দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করাতে পুত্রকে আদেশ করে আমার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন যাতে কোনো অসুবিধা না হয়। সে বেচারা তার বিকেলের খেলা মুলতুবি রেখে, তার ধুলোট দেখতে যাওয়া মুলতুবি রেখে আমার পিছু পিছু ঘুরেছে। তার মা পান করিয়েছেন শীতল শরবত আর মিষ্টি জল।


ওঁরা দেখিয়েছেন গ্রামেরই আরেকটি প্রাচীন  মন্দির, টেরাকোটার টালিতে অলঙ্কৃত। দেওয়ালের চৌকো প্যানেলে মহিলা বেহালা বাজাচ্ছেন, কেউ দধি মন্থন করছেন, অর্ধেক মাছের শরীর নিয়ে মৎস অবতার, এইসব রিলিফের কাজ। খুলে পড়ে যাচ্ছে একটি একটি করে। এদিকে  অশথ উঠিয়াছে প্রাচীর টুটি। দরজা ভেঙে গেছে মন্দিরের। শুধু নিত্য সেবাটিই হয় এখনো কোনোভাবে। একদিকে পুরোনো নিদর্শন ক্ষয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে তৈরি হচ্ছে নতুন ছবি। শিল্পবস্তু সম্বন্ধে মানুষের রুচি, ধারণা আর তার স্থায়িত্ব সম্পর্কে বিচারবোধেরও অনেক পরিবর্তন ঘটেছে, এটাই স্বাভাবিক।


কথায় কথায় বেলা পড়ে এসেছিল। অন্ধকার নেমে আসার আগে  বেরিয়ে পড়ার ইচ্ছা নিয়ে উঠে দাঁড়ানোর সময় গল্পের শেষে এসে জানলাম আসল খেলা এই গ্রামে দুবার হয়েছে। একবার একটি চলচিত্রের শুটিং এখানে হয়েছিল সেই সময়, বহু বছর আগে, হয়ত সাদাকালো ছবির জমানায়,সে কি উন্মাদনা, কি উন্মাদনা! আরেকবার হল এই ছবি আঁকার তিন দিন। আহা! এ ও গ্রামের লোক মনে রাখবে বইকি। মনে রাখবে যতদিন তারা বেঁচে থাকবে ততদিন। বাকি যেসমস্ত  "ভয়ঙ্কর খেলা" অতীতে হয়েছিল তা সব মিথ্যে, সব মিথ্যে।

ছবিতে লবনধার গ্রাম-

বনপথে

অন্নপূর্ণা মন্দির

মন্দিরের ভিতরে মূর্তির কাঠামো

মন্দিরের দেওয়ালের ছবি আর একটা পুরোনো রথ

বেরোলাম গ্রাম পরিক্রমায়


পথের বাঁকে বাঁকে ছবি

দেওয়ালে দেওয়ালে ছবি

ছবি শিকারীকে দেখে অবাক

দুপুরের নিদ্রায় গোটা বাড়ি। সেই ফাঁকে কড়া নাড়া

পুকুরের শান্ত জলে তখন ঘাই মারছে মাছেরা

দুপুরের ছায়ায় খানিক গল্পের আয়োজন

সেই ফাঁকে ছানাপোনা সমেত হাজির বিড়াল

বিরাম নেই খাবার খোঁজায়

নিজের প্রতিকৃতির সামনে

টো টো কোম্পানি

আরেক বাঁকে

থমকে আছে বিস্ময়

ভবিষ্যতের শিল্পীর অপেক্ষায়

ধর্মরাজের পুজোর জায়গা

মন্দিরের দেওয়ালে

পুরোনো মন্দির

প্রবেশ দ্বার

টেরাকোটার ফলক

বেহালা বাজাচ্ছেন

সেদিনও আজও

সময় হয়েছে বিকেলের খেলার

সময় হয়েছে কাজ সেরে ঘরে ফেরার

সময় হয়েছে ডানা মেলে উড়ে চলার


মন্তব্যসমূহ

  1. দারুন সুন্দর বর্ননা ও ছবিগুলো।

    উত্তরমুছুন
  2. গ্রাম বাংলার এমন চিহ্ন আরো আছে, তুমি খোঁজার যে আগ্রহ প্রকাশ করেছো তার জন্যে অনেক ধন্যবাদ আর ভালোবাসা। আমাদের মধ্যে এ খোঁজা টা হারিয়ে যাচ্ছে, তোমার দৃষ্টি আর বর্ণনা অসাধারণ।

    উত্তরমুছুন
  3. দারুন ছবিগুলো

    উত্তরমুছুন
  4. এত কাছে থাকি,তবু জানিনা। দেখা তো আরও অনেক দূর। আজ দু- চোখ ভরে দেখলাম। অবিশ্বাস্য। প্রাণ ভরে গেল। শিল্পীদের ধন্যবাদ। ধন্যবাদ উদোক্তাদের।টেরাকোটা, ধর্মরাজ,টলটল জলে ভরা পুকুর আমার প্রাণ জুড়ে আছে আর সোনালি স্মৃতি ।।পরেশ ঘোষ, বর্ধমান।

    উত্তরমুছুন
  5. নিটোল সুমধুর বর্ণনা ভীষণ ভাবে ছুঁযে গেল। অসাধারণ উপস্থাপন এবং সংগ্রহ রুচি প্রাণ প্রতিষ্ঠার সোপান।- প ঘো।

    উত্তরমুছুন
  6. এর ওপর ট্রাভেল মুভি করেছেন?

    উত্তরমুছুন
  7. অপূর্ব, বর্ণনাগুনে মনে হচ্ছিল আমিও লেখকের সঙ্গেই ঘুরে বেড়াচ্ছি!

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ