বনকাটির পিতলের রথ

 

'সাহিত্য পত্র', বর্ষ সংখ্যা 1377 এ তারাপদ সাঁতরা মশাই পশ্চিমবঙ্গের পিতলের রথ গুলোর একটা তালিকা দিয়েছেন। তাতে তিনি কলকাতায় দুটি, পুরুলিয়ায় একটি বর্ধমানে চারটি, বাঁকুড়ায় বারোটি, বীরভূমে ন টি, মেদিনীপুরে ছ টি, মুর্শিদাবাদে চারটি ও হুগলিতে তিনটি পিতলের রথের উল্লেখ করেছেন। নানা কারনে এই মোট একচল্লিশটি রথ দেখা সম্ভব নয় জেনেই এখনো অক্ষত থাকা সবচেয়ে আকর্ষণীয় রথের খোঁজ করলাম। বাড়ির কাছেই সিহারসোলে পিতলের রথ আছে। সেটা দেখতে যাওয়া পাকাকাকি ভাবে স্থির করার পরেও কয়েকটি রথ উৎসব চলে গেল। তারপর মনে হল আগে বনকাটির পিতলের রথটি দেখা উচিত।


চিত্তরঞ্জন থেকে পানাগড়-মোড়গ্রাম হাইওয়ে ধরে এগারো মাইল পৌঁছে বাঁ দিকে বেঁকে আরো বেশ খানিকটা গিয়ে, মানে, কিলোমিটার চারেক পরে অযোধ্যা-বনকাটি। দুটি আলাদা গ্রাম কিন্তু পরস্পর সংলগ্ন, তাই একসঙ্গেই উচ্চারিত হয়। আরেকটু দূরে ইলামবাজার।


সকাল সকাল বেরিয়ে দুর্গাপুর পৌঁছে দুর্ঘটনা ঘটল। এই মোটরবাইক আমার বহুদিনের সাথী। এতেই সওয়ার হয়ে হাজারীবাগ থেকে হেতমপুর, কাটোয়া থেকে রাজনগর বাদ রাখিনি কিছুই। আজও দোষ তার নয়। হাইওয়ের ওপর উল্টোদিক থেকে আসা সাইকেল আরোহীকে নিরাপদে রাখতে গিয়ে বিপত্তি।


দুজন শ্রমিক আর দুজন অটোচালকের সাহায্যে ও উদ্যোগে বড় একটি বেসরকারি হাসপাতালে ঠাঁই হল। সেখানে ঢোকা যত সহজ বেরোনো ততই কঠিন। ঝাড়া দু ঘন্টা পরে নানাবিধ উপদেশ সম্বলিত কাগজ আর কিছু অতিরিক্ত অলঙ্কারে সজ্জিত হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে দেখলাম মেঘ। রাঢ় বাংলায় এখন বৃষ্টির আকাল। মেঘ আসে বৃষ্টি হয় না। লোক হাঁ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কুয়ো শুকিয়ে যায়। আমার সাহায্যকারী দুই শ্রমিকের কাছেও এক ফোঁটা পানীয় জল ছিল না।


এতক্ষন বাইকটি পাহারা দিচ্ছিলেন এক ধর্মকাঁটার কর্মচারী। আমাকে ফিরে আসতে দেখে ও তক্ষুনি বাকি যাত্রা সম্পুর্ন করার উদ্যোগ নিতে দেখে সে যারপরনাই আশ্চর্য হল।

একা যাওয়ার এই এক সুবিধে। নিজেই নিজের পরামর্শদাতা হওয়া যায়। আর ওই যে কথায় আছে 'পথে পথেই দেশ', তার পরিচয় পাওয়া যায়। আমার একক যাত্রা শুভ করার জন্য বহুবিধ প্রার্থনার পর কাঁটা কর্মচারী বিদায় দিলেন। বোধ হয় তাঁর প্রার্থনার জোরেই পথে আরো বড় বড় কয়েকটি দুর্ঘটনা দেখতে দেখতে নিরাপদে পৌঁছালাম বনকাটি।

পিতলের রথ বানানো খরচসাপেক্ষ। তাই বড়লোক ছাড়া এই উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব নয়। বনকাটিতে মুখোপাধ্যায় পরিবারের সেরকম সঙ্গতি ছিল । তাঁদের অর্থনুকূল্যে খুব অল্প সময়ে এই অনুপম রথটি তৈরি হয়েছিল। রাস্তায় এত বিপত্তি সামলে রথের কাছে পৌঁছে খুব আনন্দ হল।


উত্তর দিকে ঝাড়খন্ডের বিস্তীর্ণ পাহাড় জঙ্গল প্রসারিত হয়ে এসেছে এখনকার বর্ধমানের উত্তরে বীরভূম জেলায়। তারই লাগোয়া এই বনকাটি। বিনয় ঘোষ এখানকার আদি বাসিন্দাদের সম্বন্ধে বলতে  গিয়ে প্রাগৈতিহাসিক শিকার সন্ধানী জনগোষ্ঠীর উল্লেখ করেছেন। শিকার থেকে ক্রমে যাঁরা পশুপালন রপ্ত করলেন তারাই এখানকার সদগোপ। তখনও ছিল গভীর জঙ্গল তার পরে ধর্মমঙ্গল কাব্যের ইছাই ঘোষের রাজপাট, সেটাও ছিল এইখানে। জঙ্গলের মধ্যে ছিল গড়। সেই থেকে গড়জঙ্গল। লোকমুখে এখনো ফেরে ইছাই ঘোষ আর লাউসেনের যুদ্ধের নানা কাহিনী। এখানকার গ্রামগুলো, ছোট জলধারা, ফাঁকা জমি তাদের নামের মধ্যে দিয়ে আজও সেসব যুদ্ধের স্মৃতি বয়ে নিয়ে চলেছে। ইছাই ঘোষের দেউল, যেটা অবশ্য অনেক পরে তৈরি বলে অনুমিত, সেই দেউল দেখতে অনেক পর্যটক এই বনকাটি গ্রামের উপর দিয়েই যান।


অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকেই এই অঞ্চলে শুরু হয়েছিল লাক্ষার চাষ। লাক্ষা কীট হয় কুল পলাশ শাল পাকুড় ডুমুর অশ্বত্থ গাছে। এখানকার জঙ্গলে এসব গাছের অভাব নেই। স্ত্রী লাক্ষা কীটের শরীরের থেকে একরকম রস বেরিয়ে তা জমে যায় ও পরবর্তীতে ডালপালায় ঢাকা পড়ে। সেসব পরিষ্কার করে কয়েকটি ধাপে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে গালা পাওয়া যায়। স্থানীয় আদিবাসী মানুষেরা এই কীট ও গুটি সংগ্ৰহ করতেন। প্রাকৃতিক গালার চাহিদা অনেক। বস্ত্র শিল্পে লাগে। ছাঁচে ঢালাই করে নানা জিনিস বানানো যায়। ওষুধ শিল্পেও কাজে লাগে, আগে গ্রামোফোন রেকর্ড তৈরি হত এই গালায়।


এখানকার কয়েকটি ব্রাক্ষণ পরিবার আদিবাসীদের থেকে এই লাক্ষা সংগ্ৰহ করে গালার ব্যবসা শুরু করলেন। ইলামবাজার হয়ে নদীপথে নানা গ্রামে পাইকারি ব্যবসা। ক্রমশ কলকাতায় সরাসরি, কখনো ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়েও। এইভাবে লাক্ষা ছাড়াও কাঠকয়লা গালা আর নানা বনজ জিনিসের ব্যবসায় বনকাটির মুখোপাধ্যায় ও রায় পরিবার প্রচুর অর্থ উপার্জন করলেন।


মুখোপাধ্যায় পরিবারের রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বনকাটিতে 1754 শকাব্দে তৈরি করলেন গোপালেশ্বর শিব মন্দির। সামনের দিকে টেরাকোটার কাজ। তাতে রামের রাজ্যাভিষেক, দশমহাবিদ্যা, চৈতন্যালীলা আর নানা সামাজিক ঘটনার বিবরণ আছে।


এই পঞ্চরত্ন গোপালেশ্বর শিব মন্দিরের আদলে 1241বঙ্গাব্দের 2 রা মাঘ পিতলের রথ তৈরি শুরু হয় আর 1242 বঙ্গাব্দের 15 আষাঢ় শেষ হয়। নির্মাণের এই তারিখ রথের সামনে উপরের দিকে খোদাই করা আছে। নির্মাণ করিয়েছিলেন লাক্ষা ব্যবসায়ী জমিদার রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। দেখা যাচ্ছে সাড়ে পাঁচ মাসের মধ্যে তৈরির কাজ শেষ হয়ে গেল। রথটির উচ্চতা প্রায় 15 ফুট। সামনে তিনটি, পিছনে তিনটি আর মাঝে দুটি মোট আটটি চাকা।


তারাপদ সাঁতরার মতে পিতলের রথগুলির মধ্যে এটাই প্রাচীনতম। টুকরো টুকরো পিতলের পাত ফ্রেমের মধ্যে আটকে গোটা রথ তৈরি হয়েছে। প্রতিটি খণ্ডের মধ্যে খোদাই করে আঁকা আছে রামায়ণ মহাভারতের কাহিনী, রয়েছে সেকালের সমাজ জীবনের খন্ডচিত্র। অপূর্ব সাবলীল রেখায় যেভাবে প্রতিটি অবয়ব আঁকা হয়েছে তা দেখে চোখ  ফেরানো যায় না।


অনেক লেখায় পড়েছি আচার্য নন্দলাল বসু, মুকুল দে র মত শিল্পীরা শান্তিনিকেতন থেকে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে এসেছিলেন এই রথের গায়ের অলঙ্করণ দেখাতে। বিশেষত মুকুল দে  এই ধাতু তক্ষণ শিক্ষণীয় মনে করেছিলেন। রথের গায়ে একটা খন্ডে আঁকা আছে একটি লোক হাতে লাঠি, পিঠে তার পোষা বানরছানাকে বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এই ছবিটি হুবহু কলাভবনের একটি দেওয়ালচিত্রে ও আছে। 1942-43 শে নন্দলাল বসু যখন এই রথ দেখতে এসেছিলেন তখন তাঁর ছাত্ররা বেশ কিছু ছবি রাবিং করে নিয়ে গিয়েছিলেন। স্থানীয় ইতিহাস সন্ধানী প্রণব ভট্টাচার্যের চমৎকার সব লেখা রয়েছে এই রথ নিয়ে।


রথের গায়ের ছবি গুলি খুঁটিয়ে দেখলে মনে আবিষ্কারের উত্তেজনা জাগে। উপরের দিকে বড় বড় খন্ডের একটিতে আঁকা আছে ভীষ্ম শুয়ে আছেন শরশয্যায়। অর্জুন তাঁর তেষ্টা মেটানোর জন্য মাটিতে তীর ছুঁড়ে জল বের করছেন। প্রচন্ড গরম, গোপালেশ্বর শিব মন্দিরের পাশেই বালির স্তুপের ধারে প্রখর রোদের মধ্যে রথটি দাঁড় করানো আছে। হঠাৎ এক ভদ্রমহিলা চিনামাটির থালায় কিছু ফল ও এক গ্লাস জল এনে ধরলেন। অবাক হয়ে তার দিকে দেখতে তিনি এইটুকু খেয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। এতক্ষণে আমি নিজের দিকে ভালো করে দেখলাম। দুর্ঘটনায় ছেঁড়া প্যান্ট, ধূলি ধুসরিত জামায় রাস্তার নোংরা, হাতে ব্যান্ডেজ, পায়ে ব্যান্ডেজ, বিন্দু বিন্দু রক্ত লেগে আছে পোশাকের এদিক ওদিক। খুবই লজ্জা লাগল। এইই তবে হয়ত সহানুভূতির কারন।


ভদ্রমহিলা এবার তাঁর বাড়িতে ডেকে নিয়ে বসালেন।  মুখোপাধ্যায় বাড়ির ভগ্ন দালান কোঠা লাগোয়া তাঁদের খড়ের চালার মাটির বাড়ি। পাশেই অবশ্য একটি পাকা বাড়ি বানিয়েছেন। এঁদের পদবিও রায়। গোপালেশ্বর মন্দিরের নিত্য পূজা এঁরাই করে থাকেন। দুশো বছর আগেও এরকমই পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি বাস করতেন কয়েকটি ব্রাহ্মণ পরিবার। সেইসব মুখোপায়ায় পরিবার স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে করতে একদিন বড়লোক হয়ে উঠেছিলেন।  মুখোপাধ্যায় থেকে রায় হয়েছিলেন মুর্শিদাবাদের নবাবের দেওয়া উপাধিতে।


আজ রথের রক্ষণাবেক্ষণটুকুও এঁদের দ্বারা অসম্ভব। একটি কমিটি রথ ও মেলা পরিচালনা করে। যদিও ভর দুপুরে এই নিয়ে বিশেষ সন্ধানের সুযোগ ছিল না। স্নান সেরে এসে খালি পায়ে অনেকে রথকে প্রণাম করে গেলেন। গোপালেশ্বর শিব মন্দির দেখলাম। ভিতরে বড় শিবলিঙ্গ। মন্দিরের প্রবেশ পথের উপরে টেরাকোটার কাজে রামের রাজ্যাভিষেক। পিছনে ভগ্ন প্রাসাদ, জঙ্গলে ঢাকা।


আবার রথের ছবি তুলতে থাকি। সময় ফুরিয়ে আসে। রথের চার কোনায় ঢালাই করা মৃত্যুলতা। মৃত্যুলতা একটি বিশেষ ভাষ্কর্য শৈলী। তবে এই নিয়ে বিশেষ আলোচনা হয়নি। তারাপদ সাঁতরা লিখেছেন ‘‘গবেষকদের ধারণায় এগুলি সংহারশৃঙ্খল নক্‌শা...ফুল, লতাপাতার নক্‌শা না থাকলেও রথের কোণে উৎকীর্ণ এ লতায় দণ্ডায়মান সান্ত্রী, ঝালর, ছুটন্ত ঘোড়া, বাঘ, সিংহ, মহিষ প্রভৃতি জন্তু-জানোয়ারের ওপর সন্নিবদ্ধ বর্শা হাতে কোনও অশ্বারোহী সৈন্য বা টুপিপরা সাহেব অথবা কোনও নর্তকী মূর্তির যেন এক মিছিল। আলপনা অলঙ্করণের পত্রলতা। নামকরণ মৃত্যুলতা।’’ মৃত্যুলতার দার্শনিক ও ধর্মীয় উদ্দেশ্য থাকতে পারে। কেউ বলেছেন মন্দিরে এসে আমরা যা চাই তাকে চরিতার্থতার দিকে নিয়ে যায় মৃত্যুলতা। কেউ কেউ বলেছেন মৃত্যুলতা সমস্ত মায়ার মৃত্যু ঘটায়।


আর আছে দুটি মৈথুন দৃশ্যের ড্রইং। রথের গায়ে এই অলঙ্করণ অতি বিরল। মুকুল দে স্থানীয় লোকজনকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করায় তারা নাকি বলেছিল ধর্ম যাদের টানে না তাদের ধর্মপথে আনার এও এক কৌশল। সত্যিমিথ্যে জানা নেই। হয়ত মুকুল দের আত্মজীবনী 'আমার কথা'য় এর সাক্ষ্য আছে।


রথ বানাতে কলকাতা থেকে কারিগর এসেছিলেন শোনা যায়। তবে প্রণব ভট্টাচার্যের লেখায় পড়ছি স্থানীয় আদুরিয়া অমরপুর টিকরবেতার শিল্পীরাই হয়ত এর মূল নির্মাতা। ড্রইং এ আছে কালীঘাটের পটের শৈলী। সবমিলিয়ে অতি আশ্চর্য এক শিল্পকর্ম। হয়ত অনেকেই দেখেছেন। তবে সেইদিন বহিরাগত বলতে একমাত্র আমিই ছিলাম। বনকাটি গ্রামের লোক আশ্চর্য হচ্ছিলেন শুধু বই পড়ে পরিচয়সূত্র হীন কেউ এভাবে আসতে পারে এটা দেখে।


তবে একবার নয়, বারবার দেখার, প্রতিবারই নতুন করে আবিষ্কার করার এই রথ। সেইসঙ্গে দেখা যায় গ্রামের আরো নানা মন্দির, দেখা যায় ইছাই ঘোষের দেউল শ্যমরূপার গড়। সেসব তোলা থাক অন্য দিনের জন্য।

পিতলের রথ আর গোপালেশ্বর শিব মন্দির

রথের গায়ে নির্মাণকালের তারিখ

লক্ষ্যভেদ

ভীষ্মের শরশয্যা



মেয়ের জিমন্যাস্টিক

ব্যাধ বাঁশের নল দিয়ে পাখি মারছে


হাতির সঙ্গে যুদ্ধ

পালকিতে বউ চলে যায়

নৃসিংহ অবতার

সমুদ্র মন্থন

মৃত্যুলতা

বানর ছানা পিঠে নিয়ে

রথের ঘোড়া আর সারথি

রামের রাজ্যাভিষেক

দশ মহাবিদ্যা

নৌকাযাত্রা

পূজার আয়োজন

ঈশ্বর রথে ওঠার আগে তাঁর জায়গায়



মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ