চিন্তাপুর, এভারেস্টের দেশ

                               
   চারদিকে জঙ্গলে ঘেরা কয়েকটা বাড়ি। একদম শেষেরটা রান্না আর খাবার ঘর। ভোর বেলা সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম আজ চলে যেতে হবে । সকালের রোদ গাছের পাতায় পড়ে চিকচিক করছে, সেখানে কয়েক ফোঁটা জল অশ্রুবিন্দুর মত। রাস্তায় উঠে চলতে শুরু করেছি একজন হাত ধরে টেনে আনলেন উলটো দিকে। আউল দেখেছেন? ও ডব্লিউ এল? ওই দিকে দেখুন। আমরা যে বাড়িতে ছিলাম তার সামনের বাগানের শেষ প্রান্তে একটা উঁচু পাইন গাছ , তার বেশ নিচের দিকের একটা ডালে একটাই প্যাঁচা, পেছনে সবুজ পাতায় আলোছায়ার খেলা। গুরুঙ বলল এই বাগানে আরেকটা পাইন গাছ ছিল, এটারই জোড়া। আমার দাদু সেই গাছ কেটে ফেললেন একদিন প্যাঁচাটা তো আগে ওই গাছেই বসত, উপায় রইলনা বলে উড়ে গেলসেই থেকে দাদুর কিডনির অসুখ। আমরা পুরোহিত ডাকলাম, শান্তি-স্বস্ত্যয়ন হল, সেই প্যাঁচা আবার উড়ে এসে বসল পাশের এই গাছে। সাত বছর হল সে এই ডালে বসে আছে। যতদিন সে থাকে ততদিন আমরাও আছিচলে যাবার রাস্তায় উঠে আবার পিছনে তাকালাম। অনেক নিচে নেমে গেছে বাড়িটা চারিদিকে বাঁশের জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে ছোট্ট উঠোন দেখা যায়, সেখানে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে একাকী, আমাদের যাত্রাপথের দিকে তার চোখ।

  হিংলা খোলা পার হয়ে এই যমুনা গ্রামে এসেছি। কোনো কথা ছিলনা এখানে আসার। আমাদের মত কেউ আসেও নাযাচ্ছিলাম সিকিমের উত্তরে হয়ে চিন্তাপুর। শুনেছিলাম এভারেস্ট দেখা যায় সেখান থেকে। অচিন্ত্যপূর্ব। কপাল খারাপ, উত্তরেতে পোর্টার অমিল। একে ভোট তায় তিলক। অত্যন্ত প্রশান্তির সঙ্গে সকলেই জানাল কেউ যেতে পারবেনা। ওদের কপালে বেগুনী রঙের আবিরে রাঙানো চাল যেমন ছিল তেমনই  আটকে রইল। এরা কি ভুরুও কোঁচকায়না? কপালে ভাঁজও পড়ে না একটু ? খুব জোরাজুরি করায় বলল জঙ্গলে ভালুক ধরবে। এর পর কোনো কথা চলেনা। এক এজেন্সি খুব দুর্মূল্যে দুজন পোর্টারের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করবে বলল। তবে তাদের চেষ্টার গতিপ্রকৃতি আমাদের মনে তেমন আশার সঞ্চার করল নাঅগত্যা বিরাট বোঝা জীপের এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে চালান করতে করতে পৌঁছালাম মানেভঞ্জং। রাত আটটা। মদ্যে আর পদযাত্রীতে তখনও জমজমাট সমস্ত লজ।
  উত্তরে আমদের জন্য মৌনই রইল। ভাষায় তাকে জাগাতে না পারি পদশব্দেও পারলাম না। কিন্তু খুলে গেল চিরচেনা টংলুর দুয়ার। ঝকঝকে আকাশে সারাদিন দেখা দিল কাঞ্চনজঙ্ঘা। ট্রেকার্সহাটের বাগানে মরশুমি ফুলের গাছে উড়ে বেড়লো মৌমাছি আর হলুদ প্রজাপতি। বাগানে তাঁবু লাগিয়ে রান্না করলাম সারাদিনমিশকালো বেড়াল জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে ঢুকে পড়ল টেন্টে। সাহেবদের ঘোড়া এসে ঘুলিয়ে তুলল পুকুরের গাঢ় নীল জলবেঁকেচুরে গেল ট্রেকার্সহাটের ছায়া। বেরিয়ে পড়লাম মাঠে মাঠে চড়াই উতরাই পেরিয়ে মেঘমা থেকে লোকজন যাচ্ছে জঙ্গলে। ছায়া নামল পথে। ফেরার সময় দেখি রাস্তায় সব প্রজাপতি মরে পড়ে আছে, তাদের পাখনায় তখনো উজ্জ্বল হলুদ রং টংলুর বাগানে ফিরে এসে দেখলাম কাঞ্চনজঙ্ঘার নিচে জমেছে মেঘ। আস্তে আস্তে শিখরে রং লাগল, হলদে থেকে লাল, লাল থেকে সাদার হিম রং। চাঁদ উঠল। লক্ষীপূজোর চাঁদ দুএকটি তারা উঠল, মরশুমি ফুল চাঁদের আলোয় রঙীন হলতারপর তারা ডুবে গেল চন্দ্রালোকে।
  ঠাণ্ডায় জমতে জমতেও জেগে উঠলাম ভোরের আলোয়। এখান থেকে একজন মালবাহক সঙ্গী হল আমাদের। ছেলেটির জিভ আড়ষ্ট, তাই কথা প্রায় বলেইনা সে। টংলুর ট্রেকার্সহাটে প্রতিদিন জল বয়ে আনে। মালিক শ্রীং সাহেব বললেন দেখবেন ছেলেটিকে, বড় মায়া ওর উপর। নেমে এলাম জৌবাড়ি। উঁচু নিচু ঢালে পাতাহীন খটখটে গাছ, ডালে ডালে ঝুলে আছে ফার্ন, রং বার্ন্টসায়নাআলো খুব কড়া। দৃশ্যে কন্ট্রাস্ট খুব বেশি জৌবাড়ি বিশুদ্ধ নেপাল গন্ধী গ্রাম। নুন চা খাওয়া যায়। একটা পুরোনো ল্যান্ডরোভার আছে, বাইসেপ ফোলানো দারুণ গোঁফঅলা একজন বসে আছে, চোখের গাঢ় বাদামী সানগ্লাসে নীল আকাশ আর হলুদ জমির ফিশ আই লেন্সের ভিউ। ওঁকে একটা লজেন্স দিতে চাইলাম, হেসে বললেন দাঁত খারাপ, সবই প্রায় পড়ে গেছে একটু উপরে উঠলে বাঁ দিকে মোবাইল টাওয়ার, ডান দিকে কবর। কবরের দু দিকে দুটি ভিউ। ডানহাতে কাঞ্চনজঙ্ঘা বাঁ দিকে আরে! এভারেস্ট!! একটু নিচে স্কুল, তার খেলার মাঠের মধ্য দিয়ে রাস্তা গেছে জঙ্গলে। শুধুই উতরাই। ঝিঁঝিঁর মত পোকার ডাক। জনমানবশূন্য পথ, পথে আলোছায়ার জাফরি। এঁকে বেঁকে চলতে থাকি। জীপ আসে এ রাস্তায়। সবুজ গাছের ফাঁকে ফাঁকে কয়েকটা হলুদ গাছ। কয়েকটা গাছ সাদা। ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় গাছটার পাতাগুলোর উলটো দিকটা শুকিয়ে সাদা। ঘন সবুজ জঙ্গলে মাঝে মাঝে এরকম দু একটা গাছ দেখে মনে হয় ফুল ফুটেছে। খুবই সুন্দর লাগে। ঘন্টাখানেক শুধু আঁকাবাঁকা পথে নেমে চলতে হল। সঙ্গীরা অনেক আগে এগিয়ে গেছে। ছবি তুলতে আমার দেরী হয়। খুব তাড়াতাড়ি আরো অনেক্ষণ চলার পরে মনে একটা সন্দেহ হল, রাস্তা ভুল হয়নি তো? এতক্ষণ বাঁ দিক বরাবর নেমে চলেছিলাম। কিছু আগেই একটা রাস্তা ডান দিকে বেঁকে গেছিল, সবাই সেদিকে চলে যায়নি তো? যদিও আমাদের চলার কথা জীপ রাস্তা দিয়ে, আর এখনো এই রাস্তার কিনারায় জীপের চাকার দাগ স্পষ্ট। তবু......., ঘোর জঙ্গল, রাস্তার ধারে ধারে কর্তিত বৃক্ষের অবশেষ। কয়েকটা হলুদ পাতা খসে পড়ল। ক্যালাইডোস্কোপের নকশা নড়াচড়ার মত করে ঘাসের উপর আলোছায়ার প্যাটার্ন বদলে গেল। একটা ছোট্ট ঘাসের ময়দানে এসে দাঁড়ালাম। রাস্তাও এখানে একটা বাঁক নিয়ে আবার নৈঃশব্দের গভীর জঙ্গলে ঢুকে গেছে। এখানে দাঁড়ালেই সবদিক থেকে আমাকে নজরে পড়ার সম্ভাবনা। কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে তাই দাঁড়িয়ে থাকলাম পনের মিনিট। ঝিঁঝিঁর শব্দ তীব্রতর। কারোর দেখা নেই। চিৎকার করে সঙ্গীদের ডাকলাম। সাড়া নেই। বিশাল একটা গাছ কেউ কেটে রেখে গেছে, পরে নিয়ে যাবেততদিন শুকিয়ে মরুক সেটা। একঘন্টা গেল। ভাবলাম টংলু ফিরে যাই আবার। তার আগে শেষবারের মত চিৎকার করে নিই। এইবার কেউ যেন সাড়া দিল। আবার চিৎকার, আবার সাড়া। জঙ্গলের ভিতর থেকে কচি বাঁশঝাড় কাঁধে বেরিয়ে এল অবিকল যীশু। বলল আপনিই তো ঠিক। তবে আমার সঙ্গে গেলে ছোট রাস্তায় পৌঁছে যাবেন আধ ঘণ্টায়। হাঁটুভাঙা উৎরাই পথে নেমে এলাম গ্রামে। কয়েকটা মাত্র ঘরবাড়িগ্রামের নাম নুনথালা। এক মহিলা বললেন খুব শ্রান্ত নিশ্চয়, ঘরে এসে বসুন, জল খান, চিসো পানি না তাতো পানি? সবার সঙ্গে দেখা হয়েছে, শুধু গাইড আর পোর্টার অনেক নিচে চলে গেছে। খুব পরিচ্ছন্ন কাঁচের গ্লাসে জল এগিয়ে দিল মেয়ে, গরম জল। তকতকে নিকোনো ঘরে শুধু মা আর মেয়ে। দরজা দিয়ে আলো এসে পড়ছে, একটু ধোঁয়া কোত্থেকে এসে খেলা করে গেল। নেপালী ছাড়া কোনো ভাষা কেউ বোঝে না। নমস্তে মাজী নমস্তে বইনি বলে বিদায় নিই। এর বাড়ির উঠোন, তার বাড়ির কলতলা দিয়ে রাস্তা। একজন কৌতুহলী হয়ে বেরিয়ে এলেন, বললেন থাকুন না কয়েকটা দিন নেমে আসতে আসতে শুনলাম কেউ বলছে এরা তীর্থযাত্রী।
  পাহাড়ের ঢালে চায়ের চাষ, চা তুলছে মেয়েরা। আমাদের দেখে হেসেই খুন। ট্রানজিস্টারে গান শুনছে জীনস-বালক। চলে এলাম সিসলে। দারুণ উৎরাই পথ। ছোট রাস্তায় নেমে এলাম হিঙলাখোলার বুকে। হিঙলাখোলা একটা ছোট্ট নদী, একটা হলদে কাঠের সাঁকো, সাঁকোতে রঙীন মন্ত্রপতাকা, আর ঘোড়ার খুরের মত একটা বাঁক। দূর থেকে, কাছ থেকে, নেমে -উঠে অপরূপ নদীটিকে দেখি। মানুষ বোঝাই ল্যাণ্ডরোভার শান্ত ভাবে এখানে এসে থামে। সব লোক নেমে মূহূর্তে জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে যায়নদী থেকে কুড়ি মিনিট চড়াই পথে যমুনা গ্রাম।
  আমাদের গাইডের নাম ধনকুমার গুরুং। যমুনা গ্রামে তার ভায়ের শ্বশুরবাড়ি। ধনকুমার আজ নাচবে গাইবে, মদ খাবে। এ যেন তারই বাড়ি। বাড়ির বড়মা বিশাল কাপে চা এনে দিলেন। চায়ে বিজাতীয় গন্ধ, তবে খারাপ লাগে না। এটা স্থানীয়  বাগানের চা। যত চা ফুরোয় ততবার ঢেলে দেন, এভাবে পেট ভরে যায়। বাড়ির পুরুষমানুষেরা সবাই বৃদ্ধ। একটি বাচ্চা মানসিক ভারসাম্যহীন। যুবকেরা কাজের জন্য যায় ভিন দেশে, বেশির ভাগ দুবাই, কেউ কেউ সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া। কেউ রাঁধুনি হয়, কেউ ফিটার। ওরা কাজ শেখে কাটমান্ডুতে। নীল রঙে রাঙানো কাঠের বাড়ি, ফুলের বাগান। বাড়ির সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল অতিথি আপ্যায়নে। দুট খাট টেনেটুনে জোড়া লাগিয়ে মোটা গদি দিয়ে বিছানা হল। তোরঙ্গ থেকে বেরিয়ে এল গোলাপী চাদর, বেরিয়ে এল গোলাপী ফ্রিল দেওয়া লাল সুতোয় এম্ব্রয়ডারী করা বালিশের ওয়াড়। পরিপাটি সন্ধ্যা হয়ে এল। বুদ্ধের ছবির সামনে কারুকার্যময় বাটিতে জ্বলে উঠল বাতি।
  রাতে আমাদের ডাক পড়ল আরেকটি বাড়িতে, কিছু আপ্যায়ন হবে সেখানে, হবে সান্ধ্যকালীন বিনোদন। টর্চ হাতে একটা মাটির বাড়িতে ঢুকলাম, ঘরের মধ্যে উনোন, সেখানে কিছু রান্না হচ্ছে। একপ্রান্তে মাটিতে শুয়ে আছে বছর দশেকের বাচ্চা, গায়ে কম্বল ঢাকা দেওয়া। তার মাথার কাছের জানালাটি খোলা। আধো আলোয় বাচ্চাটির মুখ দেখলাম,শীর্ন সাদা আর  অল্প বাঁকা, মাথায় কোঁচকানো চুল। কয়েকটি ছোট ছোট কাঠের পিঁড়িতে আমাদের বসতে দেওয়া হল। খোলা দরজা দিয়ে সামান্য ঠান্ডা বাতাস আসছেএকটা হিম জড়ানো সিঁড়ি উঠে গেছে উপরে কোথাও। গলা খাঁকারি দিয়ে একজন ঘোষনা করলেন – ‘আমাদের ধনকুমার খুব ভাল গায়, আজ কী শাম ধনকুমার কে নাম’হাত মুঠো করে মাইক ধরার ভঙ্গীতে মুখের কাছে এনে গান শুরু করল ধনকুমার। গানের ছন্দে ছন্দে ওর হাত উঠছে, নামছে, শরীর বেঁকে যাচ্ছে সাপের মত। আমাদের সামনে গ্লাসে গ্লাসে পরিবেশিত হয়েছে ঈষৎ হরিদ্রাভ ভাতের মাড়ের থেকে একটু ঘন পানীয় এ গৃহকর্তার উপহার। এসময়ে বাচ্চাটির গলা থেকে দুর্বোধ্য আওয়াজ এল। বাটিতে করে একটু তরল খাবার নিয়ে ঘন হয়ে এল তার মা। চামচে করে একটু একটু খাবার ঢেলে দিল মুখে সেই ফাঁকে সে তার শীর্ন হাতে জড়িয়ে ধরল মায়ের ময়লা রঙের জামা, আরো তীব্র হল তার আওয়াজ। ঝাঁঝিয়ে উঠে দাঁড়ালো মা। উপস্থিত পুরুষদের মধ্যে একজন বললেন আমি ওর বাবা। আমার মেয়েটা অসুস্থ, ডাক্তার দেখালাম কত, কিন্তু এ অসুখ ভাল হবার নয়।  তবে আজকের রাত আনন্দের রাত, আজ আমি গাইব নাচব আর এই পানীয় একদম বিশুদ্ধ। হয়ত এতে নেশা হয়, কিন্তু এ ওষুধের নেশা নয়। নেশারও শুদ্ধ অশুদ্ধ আছে। যেমন এই গানটা। কিছুটা স্খলন পতনের গান, কিন্তু বিশুদ্ধ যে গান এরপর শুরু হল তার মূল বিষয় সান্দাকফুতে চলতে গিয়ে ল্যন্ডরোভারের ব্রেক ফেল হয়ে যাওয়া। একজন ফাটা একটা তেলের ড্রাম নিয়ে বাজাতে শুরু করল, একজন স্টীলের বাটি। আওয়াজ চরমে উঠল। পানীয় আমার মুখে উঠছিলনা। জানালার নিচে বিকলাঙ্গ মৃতপ্রায় মেয়েটির মুখ। জানালার বাইরে আকাশ তারকাখচিত। মেয়েটির হাত কম্বলের বাইরে, উঁচুতে ওঠানো, যেদিকে তার মায়ের জামা। গান আরো জমে উঠল। সকলে বাইরে বেরিয়ে হিম-সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল উপরে। সেখানে আরেকটা ঘর। বিকালে দেখা সেই মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলেটিও কোত্থেকে এসে নাচতে লাগল। আমি কি নাচতে পারতাম এরকম একটা মেয়ে রেখে? এই পান ও ভোজনের আসর কি বেমানান একটু? বেমানান কি এই উল্লাস? ততক্ষনে নাচতে শুরু করেছে মেয়েটির বাবা। খেয়াল করলাম এ নাচ সেরকম ঠাকুর ভাসানের নাচ নয়। হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একটু মেয়েলি ঢঙে বেশকিছু অজানা মুদ্রা দিয়ে সাজানো। লোকটি নেচে চলেছে, কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। একটানা নাচের ফাঁকে দরজার দিকে চোখ গেল, হিম সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে অন্ধকারে, আর খুব ভারী একটা কিছু কষ্ট করে সেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসার চেষ্টা করছে। দরজার কাছাকাছি আসায় স্পষ্ট হল, পঙ্গু মেয়েটিকে পিঠে বয়ে নিয়ে উঠে এসেছে তার মা। দুজনেরই স্নেহের নজর ওই অদ্ভুত নাচের দিকে, দুজনের মুখেই হাসি। চোখ বুজে এক নিঃশ্বাসে পানীয় গলায় ঢেলে নিইতাকাবার উপায় ছিলনা। চোখের জল যদি কেউ দেখে ফেলে।
  পরদিন বিদায় নেওয়াটাও সহজ হল না। আতিথেয়তার মূল্য হয়না, তবু কিছু টাকা বৃদ্ধার হাতে দিতে চাইলাম। হাত মুঠো করে রইলেন উনি, দরকার নেই টাকার। মাটিতে ঝুঁকে প্রণাম করলাম, জোর করে মুঠো খুলে ভরে দিলাম টাকা। অনেক্ষণ অস্বস্তির আঙ্গুলে সেগুলো ধরে রইলেন উনি। অতিথির কাছে টাকা নেওয়া পাপ। অবশেষে সবাই মিলে বোঝানোয় রেহাই মিলল আমাদের। গ্রামের যুবকেরা এগিয়ে দিলেন যমুনা বাজার পর্যন্ত। পথে পড়ল পাইন গাছ, সেখানে তখনো বসে আছে সেই চিরন্তন প্যাঁচা।
   যমুনা বাজার একটা গিরিশিরার উপরে। মাত্র কয়েকটি বাড়ি। সেখান থেকে সমতল পথে আস্তে আস্তে নেমে চলি। আবার গ্রামের পথে পথে চলা। জেগে উঠেছে গ্রাম। স্কুলে যাচ্ছে বাচ্চারা, পিঠে ঘাসের বোঝা নিয়ে ঝুঁকে চলেছে মেয়েরা। গ্রামের নাম মাবো। কলা গাছ ,যব জাতীয় শষ্যের খেত, কখনো বাঁশঝাড়, কখনো আদার বাগান এই নিয়ে একেকটা গ্রাম। প্রত্যেকটি গ্রামেরই নাম মাবো। মাবো-১ থেকে এই ভাবে কিলোমিটার খানেক দূরে দূরে মাবো-৭ পর্যন্ত গ্রাম আছে। সপ্তম মাবো গ্রামে আমরা বিশ্রাম নিই। ধনকুমার চলে যায় ছাঙ পানের সন্ধানে। ওকে রোখা যাচ্ছে না। বস্তা বস্তা আদা নিয়ে অপেক্ষা করছে চাষি। কখন ল্যাণ্ডরোভার আসে, যাবে সদর শহর ইলাম। মাবো খোলা পেরিয়ে একটা বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। দুপুরে রান্না হবে এখানে, ধনকুমার রাঁধবেসেই ফাঁকে আমরা দেখে আসব এখানকার বিখ্যাত জলপ্রপাত টোর্কে। সেইমত দু  মিনিট চলেই ডান হাতে বহু দূরে সাদা লম্বা জলরেখা দেখা গেল। নেমে আসছে খুব উঁচু থেকে। অন্তত আধ ঘণ্টা লাগবে ওখানে পৌঁছাতে। কপালে যা অছে ভেবে প্রচণ্ড উৎরাই পথে নামতে থাকি। নেমে আসি একটা নদীর কাছে। খুব সুন্দর স্টিলের ব্রীজ, সেটা পেরোলেই পৌঁছে যাওয়া যায় জলপ্রপাতের একদম নিচে। হাওয়ায় বৃষ্টির মত উড়ছে জলকণা। একটা শেড আছে, সেখানে দাঁড়িয়ে সৌন্দর্য উপোভোগ করা যায়। জলের ছাঁটে ছবি তোলা কঠিন। তিন ধাপে নেমে এসেছে এই জলপ্রপাত। মনে হয় থেকে যাই এখানে একদিন। এখন পূর্ণিমা, চন্দ্রালোকে এই দুধসাদা জলপ্রপাতের সৌন্দর্য নিশ্চই আরো খুলবে। কিন্তু উপায় নেই, ধনকুমার বসে আছে রান্না করে। বেলাও অনেক হল। পৌঁছতে হবে মাইমাজুয়া, সে এখনো ঘণ্টা দুয়েকের পথ।

   টোর্কেতে খাওয়া ভালই হয়েছিল, সেটা কাজে লাগল চড়াই ভাঙতে। আকাশে মেঘ করেছে। আদার ক্ষেতের ধারে ধারে খুব চড়াই পথে এলাম মাইমাজুয়া। এখান থেকে জীপে করে চলে যাওয়া যায় ইলামমাইমাজুয়ায় থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা ভাল। তখন মেঘের ছায়ায় জমে উঠেছে সান্ধ্যকালীন ক্যারাম ম্যাচ, নিচে থেকে একটা জীপ এসে দাঁড়াল।
   মাইমাজুয়া থেকে গরুয়ালেভঞ্জং চড়াই পথ, জীপ চলতে পারে। তবে আমরা প্রায়ই শর্টকাট রাস্তা নিচ্ছিলাম, সে রাস্তায় গ্রাম আছে, আছে ভুট্টার ক্ষেত। নীল আকাশে আছে মেঘের অপূর্ব কারুকার্য, আর আছে মানুষজনের সঙ্গে সদালাপ, আছে চায়ের আমন্ত্রণ, ভুট্টাভাজা আর মূলোর চাটনির ঝাল-নোনতা স্বাদ। বেশকিছুটা যাওয়ার পর গাছপালা কমে আসে। পাহাড়ের টঙে একটাই বাড়ি, তারপর মানুষ নেই। আছে ঘাসের ঢাল, রুখা শুখা গাছ। আছে মেঘে ঢাকা নীরব শান্ত এক পুকুর, জলে ভাসছে শালুক পাতা, শুকনো একটা গাছের ছায়া। বড় বিনম্র প্রকৃতি এখানে। এই পুকুরের জলে কোনো বিশাল পাহাড়চূড়ার প্রতিবিম্ব নেই, কিন্তু গভীর এক সম্ভ্রমে আপনি এর কাছে আনত হবেন, এর চারিদিকে ঘুরে ঘুরে আপনি একা কথা কইবেন, নিজের সঙ্গে আপনার কিছু জানাশোনা হবে।

  পুকুরের নাম ফুস্রেপোখরি। চলে আসতে মন চায়না। তবু পায়ে পায়ে চড়াই ভাঙ্গতে থাকি। রৌদ্র হয়েছে অতি তীক্ষ্ণ। এখানে সব বাড়ির আঙিনাই নিকোনো। ছাগলের বদলে চরে বেড়াচ্ছে গরু। গরু চরাতে মানুষ এখানে আসে বলে এর নাম গরুয়ালেভঞ্জং। দুচারটে বাড়ি আছে, দূরে আছে গভীর জঙ্গল। সেদিক থেকে একটা রাস্তা এসেছে, সেই রাস্তার অপর প্রান্তে সান্দাকফু। কথা ছিল এখানে দুপুরের খাওয়া সেরে রওনা হব চিন্তাপুরের দিকে। কিন্ত মন উঠলনা। সারাদিন বসে বসে দেখলাম পাথরের পর পাথর সাজিয়ে তৈরী হচ্ছে আশ্চর্য বাড়ি। আমার নয় দরজা আট কুঠুরি সাজিয়ে বসে থাকি, যা পাওয়া যায় সাজিয়ে রাখি।
    রাতের অন্ধকারে গরুয়ালেভঞ্জং থেকে রওনা হলাম। হাতে টর্চ। বেজায় ঠান্ডা, সেরকমই চড়াই। পথ দেড় থেকে পৌনে দু ঘন্টার। বসার উপায় নেই। সূর্যোদয়ের আগে পৌঁছোতে হবে চিন্তাপুর। পথে কখনো কখনো জঙ্গল, কখনো ঘাসের ঢাল। জায়গায় জায়গায় পাথর বসানো। আকাশের কালো ফ্যাকাশে হল। পূর্ব দিকে রক্তাভা। নিচের পাহাড়ে ঘন মেঘ, মেঘের মাথায় রক্তাভা। চিন্তাপুর টপে খুব ভালো থাকার জায়গা আছে। পরিষ্কার কাঠের বাড়িতে দুটি ঘর। একটাতে রান্না করা আর আগুন পোহানো, আরেকটাতে শোয়া। আর আছে লাল দরজার একটা মন্দির। তবে জল নেই। এখনো সূর্য ওঠেনি, পায়ের নিচে স্তরে স্তরে নীল পাহাড়, তারপরে সাদা কাঞ্চনজঙ্ঘা সূর্যালোকে রঙীন হওয়ার অপেক্ষায়। বাঁ দিকে সঙ্গী সহ এভারেস্ট। চতুর্দিকে হিম নীল। দূরের পাহাড়ে দেখা যায় ফালুট, সান্দাকফু আমরা মাত্র পাঁচজন। ঠান্ডায় হাত জমে যায়। পূর্বদিকে মেঘ রাঙিয়ে সূর্যোদয় হল। এভারেস্টের মাথায় আপেল রঙ, তারপর কমলালেবুর রঙহলুদ হয়ে উঠল কাঞ্চনজঙ্ঘাও, তার মাথার উপরে জেট প্লেনের ধোঁয়ার মত লম্বা মেঘের রেখা। সে মেঘও ভোরের আলোয় রঙীন। হঠাৎ এক ঝাঁক পাখি এভারেস্টের দিক থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে উড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কেটে গেল ভোরের মায়া। আকাশ গভীর নীল আর পাহাড় ফটফটে সাদা হয়ে উঠলনিচের উপত্যকা থেকে মেঘ উঠে এলআলো পড়ে সে মেঘের রঙ হলুদ। প্রকৃতির পনেরো মিনিটের রুদ্ধশ্বাস ম্যাজিকের শেষ হল। আরো কিছু পাখি নিচের উপত্যকায় ওড়াউড়ি করতে লাগল। বেশ কিছুটা নেমে আসার পর দেখলাম গভীর নীল জলের আরএক পুকুর, তাতে কাঞ্চনজঙ্ঘার ছায়াএ ছায়া নিবিড় ভাবে আঁকা রইল আমাদের মনেও। এভারেস্টের দেশে এসেছিলাম, দেখা হল বিরাট পাহাড়চূড়ার সঙ্গে আর তার পায়ে কাছে থাকা ছোটখাটো কিছু মানুষের সাথে, যাদের ভিতরে অমন কতই বড় বড় পাহাড়চূড়া। যখনই চোখ বুজি টলটলে জলে দেখতে পাই বিশাল এক পাহাড়ের প্রতিবিম্ব, সেই প্রতিবিম্ব ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে আরো কিছু ছায়ামানু্‌ষ। জলের মধ্যে তাদেরও ছায়া পড়েছে খুব লম্বা হয়ে, কখনো কখনো তা স্পর্শ করছে সেই হিমশিখরের মাথা। একটি লোক নেচে যাচ্ছে, একটি শীর্ণ হাত স্পর্শ করতে চাইছে তার মায়ের পোশাকসূর্য ডুবে যাচ্ছে, বিশাল হয়ে উঠছে কাঞ্চনজঙ্ঘার ছায়া, তাতে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে মানুষের যত বৃথা কলরব। 



মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ