ভবা পাগলার মেলা


 বাংলায় বারো মাসে তেরো পার্বণ’ কথাটা ছো্টবেলা থেকে শুনে এলেও কয়েকটি বিশেষ পার্বণ ছাড়া বাংলার অন্যান্য পার্বণে সক্রিয় অংশগ্রহণের তাগিদ সেভাবে উপলব্ধি করিনি। কিছুকাল আগে ঘটনাচক্রে এরকমই এক পার্বণ উপলক্ষ্যে আয়োজিত মেলায় গিয়ে চৈতন্যোদয় হল। তারপর থেকে প্রতি মাসেই ঘুরে বেড়াচ্ছি বাংলার মেলায় মেলায়। যত ভ্রমণ করছি তত বহু বিচিত্র চরিত্রের সংস্পর্শে এসে ভরে যাচ্ছে মন। তার সবটা বলা এখানে সম্ভব নয়। দরকারও নেই। শুধু প্রতি মাসের মেলা ভ্রমণ ছবি সহ একটা গাইড বই এর মত করে যদি আপনাদের সামনে রাখা যায়, যদি আপনারাও কেউ উৎসাহিত হয়ে ঘুরে আসেন, এই আশায় একটি একটি করে বারো মাসে বারোটি মেলার বর্ণনা-


বৈশাখ মাস-
শুরুটা তবে এক কবিকে দিয়েই করা যাক। বৈশাখ মাসের শেষ শনিবার সকাল সকাল ব্যান্ডেল-কাটোয়া লোকাল ধরে নামলাম অম্বিকা কালনা স্টেশনে। স্টেশন থেকে বেরিয়েই রয়েছে প্রচুর টোটো। মন্দির শহর হিসেবে কালনার নামডাক। তবে আজ বিশেষ দিন, তাই টোটো চালক অবিরাম হেঁকে যাচ্ছেন ‘ভবার বাড়ি’ ‘ভবার বাড়ি’। যাঁর নাম তাঁরা করছেন সেই সাধক-কবি, রামপ্রসাদ ঘরানার কবিতার সার্থক উত্তরসুরী ভবেন্দ্রমোহনের আদত জন্মভিটা ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ মহকুমার আমতা গ্রামে সাহা চৌধুরী পরিবারে। পিতার নাম গজেন্দ্রমোহন চৌধুরী। মা গয়াসুন্দরী দেবী চৌধুরাণী। সাহা চৌধুরী পরিবার নোটামুটি ধনীই ছিলেন বলা যায়। এঁদের তিন তরফের মধ্যে মেজ তরফের কর্তা গজেন্দ্রমোহন। তাঁর বড়ছেলে গিরীন্দ্রমোহন সাধু স্বভাবের। লোকে তাকে গিরীন সাধু বলে। গজেন্দ্রমোহনের পঞ্চম সন্তান ভবেন্দ্রমোহন। ১৩০৯ সালের আশ্বিন মাসে শুক্রবার কোজাগরী লক্ষীপূজোর দিন গয়াসুন্দরী দেবী যমজ সন্তানের জন্ম দিলেন। প্রথমে দেবেন্দ্র, তার কয়েক মিনিট পরে ভবেন্দ্রর জন্ম হল। মুর্শিদাবাদ জেলায় এক ভক্ত সমাবেশে ভবেন্দ্র আত্ম পরিচয় দিয়ে গেয়েছিলেন
      “পূরব বঙ্গের ঢাকার গর্ভে গর্বিত গ্রাম আমতা।
       সেই গ্রামে জনম মোর, পিতা গজেন্দ্র,গয়ামাতা ।।
       বাঁচন মরণ এই দুই কূল, সমাজ অমর ধাম।
       সেই সমাজের অধিকারী মুই, ভবা পাগলা মোর নাম ।।”
 ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ভবা পাগলা ভারতে আসেন (১৯৫০)। তারপর নানা জায়গা ঘুরে বর্ধমানের কালানার জাপটে  বসবাস করতে থাকেন। এখানেই প্রতিষ্ঠা করেন ভবানী মন্দির। মন্দির প্রতিষ্ঠার পরেই বৈশাখ মাসের শেষ শনিবার বিশেষ উৎসব শুরু করেন ভবা পাগলা। আজও তা চলছে। টোটো নামিয়ে দিল বড় রাস্তার এপারে। রাস্তা পার করে ঢুকে পড়ি অপেক্ষাকৃত ছোট গলিতে। সে গলির দুধারে তখন অল্পই মেলা মেলা গন্ধ। রাস্তার পাশে সবুজ জলের পুকুর। পুকুরের পাড়ে কলা গাছ। তারই ফাঁকে ফাঁকে পসরা নিয়ে মাটিতে বসেছে দোকানি। বিক্রি হচ্ছে ফুল। যেসব ভক্তজন মেলায় আসবেন প্রথমে পূজো দেবেন ভবানী মন্দিরে। এ তারই আয়োজন। বিশেষত্ব গোলাপ ফুলের  আধিক্যে। মাথায় ঝাঁকা করে বিক্রি হচ্ছে রাশি রাশি টকটকে লাল গোলাপ। একেকটার দাম দু টাকা। বড় বড় ছাতা টাঙ্গিয়েও বসেছে ফুলের পসরা। পুকুরের পাশে টিঊবওয়েলের হাতলে চাপ দিয়ে মহানন্দে জল ভরছে ছোট্ট শিশু। একটাই রাস্তা এঁকে বেঁকে চলে গেছে ভবার বাড়ির দরজায়। বাড়ির পাশেই গাছতলায় বড় চত্বর ত্রিপল দিয়ে ঘিরে তৈরী হয়েছে মঞ্চ। ভবার গান গাইছেন শিল্পীরা। সামনে বসে আছেন প্রচুর শ্রোতা। ভবা কত গান লিখেছিলেন তা নিশ্চিত নয়। ভক্তেরা কেউ বলেন ছিয়াশি হাজার, কেউ বলেন পঁচিশ হাজার, গবেষকরা মনে করছেন সংখ্যাটা হাজার দশেক হবে। ভবানী মন্দিরে পনেরোটি গানের খাতায় মোট লিখিত গানের সংখ্যা ছ হাজার। সবকটি সংখ্যাই আশ্চর্যজনক। শুধু তাইই নয়, প্রতিটি গানে সুর সংযোজনও ভবার। সেই গান-মঞ্চের উলটো দিকেই রয়েছে আরেকটা পুকুর। পুকুরের পাড়ে ভবানী মন্দিরে ঢোকার দরজা। মন্দিরে পুজো দেওয়ার লম্বা লাইন। পুজো না দিলেও দর্শনে অসুবিধা নেই। মন্দিরে ভবার আঁকা পদ্ম ফুলের ছবি, পাপড়ির ফাঁকে একটি বালকের মুখ, নিচে নিজের নাম লিখেছেন- ভবা। ভবার ভবানী যেদিকে মুখ করে আছেন সেদিকে একটা ফাঁকা চাতালের পরেই ভবার সমাধি। সে যেন আরেকটা মন্দির। সমাধির নিচে লেখা ‘এই জনমের মত ভবা ঘুমিয়ে গেল’ (১৯৮৪ র তেরোই ফাল্গুন)। আর বাইরে একটা কবিতা, নাম ‘অবসান’। সমাধি মন্দিরের পিছনেই একটা গাব গাছ। বাংলাদেশে ভবার জন্মস্থানটিও ছিল ফল ফুল গাছে পরিপূর্ণ। গাব গাছটির নিচেও একটা ফলক তাতে লেখা ‘সিদ্ধ গাব গাছে তলায় কত খেলাই হ’ত। মা কে দিতাম মাটির সন্দেশ মা আমার তাই খেতো। সেই গাছেরই বংশধর ওগো খেলার সাথী। গাব ফুলেই করতাম পূজা গাবের মালা গাঁথি।। বহু কষ্টে নিয়ে এলাম পূর্ববঙ্গ হ’তে। যুগ যুগান্তর থেকো বৃক্ষ সাধন শিক্ষা দিতে।।’ গাব তলার পরেই দক্ষিণের দুয়ার। সেখান দিয়ে বেরিয়ে আবার পুকুরের পাড়। জল থেকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি উঠে গেছে বড় একটা বট গাছের তলায়। সেখানে কালচে সবুজ ছায়া। গাছের তলাটা বাঁধানো। কয়েকজন লাল কাপড় পড়া সাধু ধরণের লোক বসে আছে। একদল তৃতীয় লিঙ্গের মানুষও এসেছেন। তাদের দলনেত্রীর পরণে সাদা সালোয়ার কামিজ। একটি দাঁত সোনায় বাঁধানো। সেই দাঁত ঝিকমিক করে তিনি বললেন আমি ভবার ছেলের সঙ্গেও দেখা করেছি। তবে কি জানো দাদা, মা-ই সব। বলেছি আমার কিছু নাই। মা-ই তো নেই আমার। খুঁজে দাও বাবা, ‘এসো মা কালী, শুন মা বলি/ আমার প্রাণের বেদনা/লাগে না ভালো কি যে করি/তুমি আমায় বল না’। দাঁত ঝিকমিক করল আবার। চোখে জল এলে মুখে লালা আসে। মনে হল এই ঝিকিমিকি সেই অশ্রুসিক্ত লালার। এই দলেরই একজন লাল পাড় সাদা শাড়ি পরেছেন আটপৌরে করে। ছবি তুললাম তাঁর। বললে-‘কি সৌভাগ্য, আমারও ছবি হয়!’ এরপর সবজে শ্যাওলা পড়া বিবর্ন দেয়ালকে পিছনে রেখে নানা রকম ভঙ্গীমায় দাঁড়াতে লাগলেন তিনি। গায়ের রঙ তাঁর মসীকৃষ্ণ। চোখ দুটিও ঘন কালো, তাতে আইলাইনার লাগানো। সেই চোখে লজ্জা ফুটিয়ে, মাথায় ঘোমটা টেনে নানা ভঙ্গীতে ছবি তুলে তিনি দৌড়ে গেলেন। দৌড়ে নয়, যেন পালকের মত উড়ে। আজ তাঁর খুশির দিন, কেউ একজন তাঁর ছবি তুলেছে। “এখনো সেই বৃন্দাবনে/ বাঁশি বাজে রে/ কালার বাঁশি শুনে/ বনে বনে ময়ূর নাচে রে/ এখনও সেই নীল যমুনায়/ জল আনিতে যায় ললনায়/ কদমতলে সেই ছলনায়/ কৃষ্ণ আসে রে/ আশা ছিল মনে মনে/ যাবো আমি বৃন্দাবনে/ ভবা পাগলা রয় বাঁধনে/ মায়ার বাঁধনে।” একটু একটু করে লোক বাড়ছে, সেইসঙ্গে গরম। পাখাওয়ালা লাল-নীল প্লাস্টিকের পাখা বিক্রি করছে। ১০ টাকা দাম। তারই একটা কিনে আবার গাছতলায় বসলাম। এবার রক্তবস্ত্র পরিহিতা এক সন্ন্যাসিনী এলেন। তাঁর মুখ ঘামে ভিজে। গালের হনু উঁচিয়ে আছে। গলায় একগাদা রুদ্রাক্ষের মালা। মাথায় তিনকোনা টুপির মত কাপড় জড়িয়ে রাখা। তার নিচে হয়ত জটাজুট। কি মনে করে পাখা এত জোরে নাড়ালাম যেন তাঁর গায়েও একটু হাওয়া লাগে। সঙ্গে সঙ্গে আমার হাত থেকে পাখা ছিনিয়ে নিয়ে তিনি আমাকেই হাওয়া করতে লাগলেন। মুখে বললেন-‘আমার বাবাকে আমি একটু হাওয়া করি’। মহিলা হাওয়া করে চলেছেন। নিরুপায় বিব্রত আমি সামনের দিকে তাকিয়ে আছি। এক জটাজুটধারী প্ল্যাস্টিক বিছিয়ে মাটিতে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাঁর সামনে কয়েকটা খুচরো পয়সা আর কমন্ডলু। চোখের সামনে দিয়ে দলে দলে লোক ভবার বাড়ি দেখতে যাচ্ছে। সন্ন্যাসিনী হাওয়া করতে করতে বললেন মানুষ দেখ বাবা। সাধুসঙ্গ করবে, তা সেই সাধুর ঠিক কি? কে বা জানে তিনি আসল কিনা। হয়ত দশ বছর ঘুরলে তারপর দেখলে সব ফক্কা। কিছুই জানেন না তিনি। তার চেয়ে বাবা নাম কর। গুরুর দেওয়া নাম। নিঃশ্বাস নাও আর ছাড়ো। পূরক রেচক মাঝে কুম্ভক। চার-ষোল-আট মাত্রা। তারপর বাড়িয়ে আট বত্রিশ-ষোল। আর, বেশি ক্ষয় কোরোনা। প্রথমে সপ্তাহে একবার তারপর মাসান্তে। স্ত্রী কে বোঝাও। ভবার বাড়ির দিকে লোক যাচ্ছে। দলে দলে লোক। ‘সাধকের মন পদ্মে নীল পদ্ম ভাসে গো/ চরণ, কমল পদ্ম, সরষে হরষে গো/ আগমে নিগমে গতি সরমে, ঐ কাম, রতি/ ভয়ে ভীত হয় যুবতী কু প্রবৃত্তি ত্রাসে গো’। চা খাবে বাবা? সন্ন্যাসিনী জিজ্ঞাসা করলেন। আমি থতমত খেয়ে বললাম- না। তারপর উনি ট্রেন ধরতে হবে বলে চলে গেলেন। আমার সামনে যে জটাজুটধারী প্ল্যাস্টিক বিছিয়ে বসেছিলেন, তিনি হাত দেখা শুরু করেছেন। ভিড় জমে উঠেছে তাঁর আশেপাশে। একটু মেলা দেখতে বেরোলাম। ভবার বাড়ির পিছন দিকে বেশ কয়েকটা আখড়া। সেখানে ভক্তদের জন্য রান্না হচ্ছে দুপুরের খাবার। খানিক দূরে আমের বাগান। প্রখর গরমে সেখানে বিশ্রাম নিচ্ছে ভক্তেরা। সঙ্গে এসেছে তাদের পোষা ছাগল। খেলে বেড়াচ্ছে তারা ছায়ায়। কখনো কোলে উঠছে। বেলা পড়ে এল। আবার এলাম সেই গাছতলায়। চাওয়ালা এখনো বসে আছে। এককাপ চা খেলাম। পয়সা দিতে গিয়ে বিপত্তি। কিছুতেই নেবে না। খালি বলে ‘ও, লাগবেনা’। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। এদিকে লজেন্স বিলি করছে কেউ। তা নিতে ভিড় জমেছে। গান-মঞ্চের গান এখনো চলেছে। গায়কের পায়ে মাথা লুটিয়ে প্রণাম করলেন এক বৃদ্ধা। যিনি গান জানেন তিনি যে ভগবান এখানে এসে আবার সে উপলব্ধি হল। গায়কের কণ্ঠস্বর আবেগে রুদ্ধ হয়ে এল। লাল পাড় সাদা শাড়ি হাঁ করে গান শুনছে। ঘামে তার মেয়েলি প্রসাধন নষ্ট হয়ে গেছে, তার পিঠের উপর পুরুষালি লোম প্রকট হয়ে উঠেছে তবুও তাকে এখনো মেয়ে বলেই মনে হচ্ছিল। গায়ক গান গেয়ে চলেছিলেন- ‘মধু খাবি লুটিয়ে প’ড়ে/ গান গাইবি মধুর সুরে/  আর ভ্রমরা যাসনি উড়ে/ বিকিয়ে যা রে পায়/ নীল সাগরে চাঁদের আলো/ ঢেউয়ের মাঝে, বিলিয়ে দিল/ ডুবে, গেল কি, ভেসে উঠলো বোঝা বড়ই দায়’।     

স্টেশন থেকে ভবার বাড়ি 


ভবার ভবানী মন্দির


সিদ্ধ গাব গাছ


 ্লাল পাড় সাদা শাড়ি
ভবার দক্ষিণ দুয়ারে
 নাম জপ বাবা


 লজেন্স নেওয়ার হুড়োহুড়ি
বড্ড গরম


 জলসত্র


হরেক মাল পঁচিশ টাকা 

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ