রামকেলি মেলা/ জ্যৈষ্ঠ মাস
জ্যৈষ্ঠ মাসঃ-
জ্যৈষ্ঠ মাসে রামকেলির
মেলা থেকে একটা হাতপাখা কিনেছিলাম। খুব সাধারণ একটা তালপাতার পাখা। তাতে কোনো রঙ
ছিল না। কারুকার্য একটা ছিল বটে, তবে সেটাও ওই পাতা মুড়ে মুড়ে। তার হাতল ঘুরিয়ে
ঘুরিয়ে হাওয়া করলে মেলাটার কথা আমার খুব মনে পড়ত। সে অনেক কাল আগের কথা, ১৫১৪
সালের বিজয়াদশমীতে বৃন্দাবন যাবেন বলে শ্রীচৈতন্য নীলাচল থেকে রওনা হয়ে রামকেলিতে
এসে পৌঁছেছিলেন ১৫১৫ সালের জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তিতে। আসা-যাওয়ার সময় কুমারহট্ট ফুলিয়া
বরানগর পানিহাটি এইসব জায়গায় গেলেও শেষ পর্যন্ত সে যাত্রায় বৃন্দাবন যাওয়া তাঁর আর
হয়ে ওঠেনি। কানাই এর নাটশালায় যাত্রাভঙ্গ করে আবার নীলাচলে ফিরে গেলেন তিনি। সেই
থেকে রামকেলি গ্রামে শ্রীচৈতন্যের আগমন উপলক্ষ্য করে চলে আসছে মালদা জেলার সবচেয়ে
বড় এই মেলা।
ভাতের মাড়ের মত গরম
ঘোলাটে জ্যৈষ্ঠের আকাশের নীরব অসহযোগিতা সহ্য করেও বর্ধমান স্টেশনে পৌঁছে যখন
শুনলাম হাওড়া-মালদা ইন্টারসিটি বাতিল, ভাবলাম আমারও যাত্রাভঙ্গ হল এখানেই।
চৈতন্যদেব তো হেঁটেই এসব জায়গা ঘুরে ফেলেছিলেন, সেসময়ও তো আকাশ থেকে এরকম আগুন ঝরছিল,
তবে আমার আর অসুবিধে কি। অসুবিধে একটা ছিল। সেটা হল ট্রেন বাতিলের সঙ্গে সঙ্গে আগে
থেকে কেটে রাখা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সংরক্ষিত আসনের টিকিটও বাতিল। মনে পড়ল- ব্রাহ্মণ
জাতি তারা নবদ্বীপে ঘর/নীচ সেবা নাহি করে নহে নীচের কুর্পর। তাইতো বটে, দুঃখী অথচ
সহিষ্ণু জনতার ভিড় এড়িয়ে গেলে চলবে কি করে। তাদের স্পর্শ পাওয়ার জন্যই তো মেলায়
যাওয়া। অতএব কোনোক্রমে একটা বিকল্প ব্যবস্থা করে উঠলাম সরাইঘাট এক্সপ্রেসে, ট্রেন
থেকে নামিয়ে দেওয়ার সমূহ সম্ভাবনা মাথায় নিয়েও। থ্রী টায়ারের এক কোণায় জড়সড়ো হয়ে
দাঁড়িয়ে আছি দেখে ট্রেনের সাফাইকর্মীরা তাঁদের সীটে বসতে দিলেন। বালতি ন্যাতা
ফিনাইলের বোতল সুগন্ধী রুম ফ্রেশনারের সঙ্গে কেটে গেল বাকী পাঁচ ঘন্টা। এখনো যখন
মেলা থেকে আনা পাখাটা অন্যমনষ্ক ভাবে ঘুরিয়ে ফেলি নাকে আসে ফিনাইলের গন্ধ। আবছা
দেখতে পাই তাকে, নীল জামা পরে হাতে বালতি নিয়ে এক অসুস্থ যাত্রীর বমি পরিষ্কার
করতে যাওয়ার আগে যে বলল ‘বোসো কাকা, তোমার রামকেল বহুদূর’।
এইরকম নাটকীয়
বস্তাপচা দৃশ্যের অভিনয় আমায় বহুবার দেখতে হয়েছে। অভিনয় যাঁরা করেছেন তাঁদের কেউ
কেউ এই মধ্যরাত্রে বাঁধানো স্টেশন চত্বরে শুয়ে-বসে আছেন। কপালে তিলক, গলায় কণ্ঠী।
তাঁরা সবাই মহিলা। সামনের বাটিতে মুড়ি। কাল জ্যৈষ্ঠ মাসের সংক্রান্তি। কাল থেকে
শুরু রামকেলির মেলা। কয়েক ঘন্টা এভাবেই কাটিয়ে টোটো ধরে ওঁরা যাবেন সামান্য
দূরত্বের রথবাড়ি মোড়। সেখানে অনেক ছোটবড় গাড়ি চিৎকার করছে ‘রামকেল’ ‘রামকেল’। এরপর
কোনো একটা বৈষ্ণব দলের সঙ্গে মিশে তাঁরাও উঠে পড়বেন একটা গাড়িতে, সেটা তখনই চলবে
যখন ভিতরে নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গাটুকুও আর থাকবে না। রথবাড়ি মোড় থেকে রামকেলি্র
প্রবেশ পথ পিয়াসবাড়ি মোড় ১৬ কিলোমিটার। আধ ঘন্টার এই রাস্তায় যদি বাইরে তাকাবার
সুযোগ পান, দেখবেন দু ধারে আমের বাগান, চাষের ক্ষেত, পিঠে ঝোলা নিয়ে মেলার দিকে
হেঁটে যাচ্ছে দু একটি পরিবার। পিয়াসবাড়িতে অটো থেকে নেমে হেঁটে চললাম। চাষের
ক্ষেতে নীল রঙা মশারি টাঙিয়ে ঘুমোচ্ছে বৈষ্ণব। পথের দু ধারে পরপর টুকরো টুকরো লাল শালু ছেঁড়া শাড়ি, গামছা পাতা। তাতে ছিটিয়ে রয়েছে
ভিক্ষার চাল। এত ভোরে একজনও ভিক্ষুক নেই। এ শুধু নিজের জায়গা দখলে রাখা। শ্রীচৈতন্য
আসবেন শুনে নৃসিংহানন্দ এই পথ বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন সে কথা চৈতন্যচরিতামৃতে আছে-
কুলিয়া গ্রাম হইতে পথ রত্নে বান্ধাইল/নিবৃন্ত পুষ্প শয্যা উপরে পাতিল/পথে দুই দিগে
শোভে বকুলের শ্রেণী/মধ্যে মধ্যে দুই পাশে দিব্য পুষ্করিণী। সেই পুষ্করিণীতে স্নান
সেরে ভিজে কাপড়ে ঢুকে যাচ্ছে কেউ অস্থায়ী আখড়ায়, কেউ দাঁত মাজছে। ভোরের কীর্তনের
প্রস্তুতি চলছে, হারমোনিয়ামে বেজে উঠছে-জয় জয় শ্রীচৈতন্য জয়
নিত্যানন্দ/জয়াদ্বৈতচন্দ্র জয় গৌড় ভক্তবৃন্দ।
এরকমই এক ভোরে,
ঠিক ভোর নয়, রাত্রির চতুর্থ প্রহরে শ্রীচৈতন্য রামকেলি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন কানাই
এর নাটশালের দিকে। তার আগের রাত্রে তাঁর
সঙ্গে নাটকীয় সাক্ষাৎকার হয়েছে হোসেন শাহের দুই মন্ত্রীর। ‘ভুঞাবাড়ি্র
বিষ্ণুমন্দিরের চাতালে কাঠের পিঁড়ির ওপর গোরা বসেছিল। বিষ্ণুর আসনের সামনে লম্বা
এক পিলসূজের ওপর বড়ো প্রদীপ জ্বলছে। প্রদীপের আলো হালকা ভাবে চাতালে এসে পড়েছে।
দু’পা মুড়ে দু’হাঁটু সামনে রেখে সন্ন্যাসী বসে রয়েছে। তার বাঁ পাশে কমন্ডুল। সাকর মল্লিক,
দবীর খাস দন্ডবৎ হয়ে প্রণাম করল।। গোরা উঠে দাঁড়িয়ে দু’ভাইকে পরপর বুকে জড়িয়ে ধরতে
তারা বলল, প্রভু এ কি করলেন? আমাদের জাতধর্ম নেই, আমরা পতিত।
গোরা হাসল, বলল,
তোমরা বিনয়ী, প্রেমভক্তি ছাড়া এমন বিনয় হয় না, তোমরা আসল বৈষ্ণব’। (গোরা/শৈবাল
মিত্র)
যেখানে এই সাক্ষাৎকার
হয়েছিল বলে লোকে মনে করে সেখানে এক বিরাট গাছ। কেলিকদম্ব। তেমনই বিরাট এক
চৈতন্যমূর্তি। দুবাহু উপরের দিকে তোলা। নিচে লেখা আছে সেই সাক্ষাৎকারের কথা। আর
গাছের নিচে ছোট একটা মন্দির। তার মধ্যে লালচে একখন্ড পাথরে দুটি পায়ের ছাপ।
শ্রীচৈতন্যের। দুধ মেশানো জল সেই চরণচিহ্নের গভীরে ঢুকে ছাপকে আরো স্পষ্ট করেছে।
ভুঞাবাড়ি্ কোথায় তা জানা নেই। রাস্তার ধারে ধারে মাটির নিকোনো ঘর। টালির চাল।
সঙ্কীর্ণ রাস্তা অদূরে যেখানে থমকে গেছে মনে হয়, ভোরের ধোঁয়াটে আবছায়ায় সেখানে খুব
বড় প্রাচীন এক ইমারত নজরে পড়ে। বড়সোনা মসজিদ বা বারোদুয়ারি। স্নান সেরে ইতিমধ্যেই
মেয়েরা সেখানে শাড়ি শুকোতে দিয়েছেন লম্বা করে। মসজিদের আশেপাশে ভেতরে যেখানে
যেখানে গাঢ় সবুজ ঘাস সেখানেই বিচিত্রবর্ণের শাড়ির আল্পনা। মসজিদের ভিতরে শীতল
পাথুরে মেঝেতে দাড়িওয়ালা সাধুর পাশে বসে আয়না নিয়ে ভেজা চুল আঁচড়াচ্ছেন রমনী। এক
বাঁশিওয়ালা তাদের চারিপাশে বাঁশি বাজিয়ে বাজিয়ে ঘুরছে। বাটিতে জলে ভেজানো মুড়ি আর বাঁ
হাতে পাকা আম নিয়ে বসে পড়েছে বাচ্চা ছেলে। অতি বিশাল আর উঁচু উঁচু খিলান। নিরেট
পাথরের তৈরী। কোনো কারুকার্য নেই। পুরু স্তম্ভের ওপর গোল গোল গম্বুজ। মসজিদের উপর
থেকে বড় গাছের ছায়ায় ঢাকা নিচের মেলার খানিকটা অংশ দেখা যায়। আম খেয়ে সুন্দর করে
ছাঁটা ঘাসের উপরেই খোসা ফেলে চলে যাচ্ছে এক পরিবার। মসজিদ চত্বরেই কেয়ারি করা
গাছের ফাঁকে বাঘ নিয়ে বসে আছে ফোটোগ্রাফার। পেটে তুলো ভর্তি নরম কাপড়ের গম্ভীর সেই
বাঘের সঙ্গে ছবি তুলে গেল এক বৈষ্ণব গুরু, সঙ্গে আট দশ জন শিষ্য শিষ্যা। গরমে
গায়ের জামা ভিজে উঠেছে। মসজিদ চত্বরে ঘাসের উপর বসে সেই নিরাভরণ তালপাতার পাখাটিকে
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অতীতে চলে যাওয়া যায় অনায়াসে। শ্রীচৈতন্য যখন রা্মকেলিতে এসেছিলেন
বড়সোনা মসজিদ তখনো তৈরী হয়নি। হোসেন শাহের রাজধানী একডালা থেকে একটু বেশি রাতে
ছদ্মবেশে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেন সাকর মল্লিক আর দবীর খাস যাঁদের নাম অমর আর
সন্তোষ। এঁরা দুজনেই ব্রাহ্মণ হলেও বুদ্ধিবলে আর কিছুটা রাজ জ্যোতিষী চারুমিহিরের
সুপারিশে হোসেন শাহের দরবারে গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছিলেন। সাকর মল্লিক মানে প্রধান
মন্ত্রী আর দবীর খাস একান্ত সচিব। শ্রীচৈতন্য রা্মকেলিতে আসার আগেই অমর আর
সন্তোষের সঙ্গে তাঁর পত্রবিনিময় হত। মুসলমান সুলতানের দরবারে আমীর বনে যাওয়া অমর ও
সন্তোষ হিন্দু সমাজের চোখে যবন হয়ে পরিত্যক্ত হয়ে গেল কিন্তু রাজার চোখে তারা সেই কাফেরই
রয়ে গেল। আত্মপরিচয়ের সঙ্কটে ভোগা এই দুটি পন্ডিত মানুষকে শ্রীচৈতন্য সেই রাতে
রামকেলিতে বৈষ্ণব সমাজের অন্তর্ভুক্ত করে তাদের নতুন নাম দিলেন। বড় ভাই অমরের নাম
হল সনাতন ছোট সন্তোষের রূপ। বুদ্ধিমান রূপ-সনাতন সে রাত্রে শ্রীচৈতন্যকে একটি
মূল্যবান পরামর্শও দিয়েছিলেন, সেটি হল অবিলম্বে রামকেলি ছেড়ে যাওয়া। এত লোক-লস্কর
নিয়ে এরকম উচ্চৈস্বরে নামগান শ্রীচৈতন্যের প্রাণশংশয় করতে পারে। ইহাঁ হইতে চল
প্রভু ইহাঁ নাহি কাজ/যদ্যপি তোমারে ভক্তি করে গৌড়রাজ/তথাপি যবন জাতি না করি
প্রতীতি/বন যাত্রায় এত সংঘট্ট ভাল নহে রীতি/যাহা সঙ্গে চলে এই লোক
লক্ষকোটি/বৃন্দাবন যাত্রার এ নহে পরিপাটি।।
নিচে মেলা থেকে
মাইকে হরিনাম সঙ্কীর্তনের শব্দ ভেসে আসছিল। এতক্ষণ এলিয়ে বসে থাকা কাপড়ের বাঘের
পাশে এসে দাঁড়িয়েছে রুগ্ন মা তার দুটি ছেলেমেয়ে নিয়ে। পরিবারের কর্তা নেই। বাঘটি
সেই অনুপস্থিত কর্তার জায়গা দখল করল। দুপাশে দুই ছেলেমেয়ে, একদিকে মা। মধ্যিখানে
বাঘ। খচ করে শাটারের শব্দ হল। ওদের মেলায় আসার স্মৃতি চিরস্থায়ী হয়ে রইল।
ফোটোগ্রাফার এসেছেন বারাণসী থেকে। বাঘ নিয়ে ছবি তোলার জন্য চারদিনে মেলা
কর্তৃপক্ষকে পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয়। এরপর আর সামান্যই লাভ থাকে। রূপ-সনাতন শ্রীচৈতন্যকে
বললেন-প্রভু আমাদের কি হবে? গোরা বললেন পৌষসংক্রান্তিতে প্রয়াগে এসো, দেখা হবে।
মসজিদের নিচে
বিশাল বট গাছে্র তলায় শিল নোড়া বিক্রি হচ্ছে, পাথর খোদাই এর ছেনি হাতুড়ির শব্দে
শিলের উপর ফুটে উঠছে মাছ পাখি আর জলের ঢেউ এর ছবি। রাস্তায় হাজারো লোক।
নামসঙ্কীর্তন করতে করতে শ্রীচৈতন্য যখন রা্মকেলিতে আসছেন তাঁর পিছনে পিছনে এরকমই
লক্ষ লক্ষ লোক চলেছিলেন। ‘যাহাঁ যায় প্রভু তাহাঁ কোটি সংখ্য লোক/দেখিতে আইসে দেখি
খন্ডে দুঃখ শোক/যাঁহা যাঁহা প্রভুর চরণ পড় এ চলিতে/সে মৃত্তিকা লয় লোক গর্ত হয় পথে।।’
দুপুর হয়ে গেল।
পথের ধারে হোটেলে নিরামিষ ভাত। আলু ভিন্ডি পটল ভাজা। ডাল। পাঁচমিশালি সবজি। তিরিশ
টাকা। পাশে সেই তালপাতার পাখাটা রেখে খেতে বসেছিলাম, হাত ধুতে উঠে গিয়ে ফিরে এসে
দেখি পাখা নেই। খানিকটা দূরে একজন লোক আমার মতই একটা পাখা নিয়ে হাওয়া খাচ্ছে। ব্যস্তসমস্ত
হয়ে তার দিকে ছুটে যাই। অম্লান বদনে পাখাটা আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে লোকটি বলল- আমি
এই দোকানের কর্মচারী। খুব সুন্দর পাখাটা তো তাই একটু হাওয়া খাচ্ছিলাম। যদিও পরে
তাকে দোকানে আর দেখলাম না। সেই থেকে পাখাটার ব্যাপারে একটু বেশি সতর্ক রইলাম।
খাওয়ার হোটেলের উলটো দিকে মাটির বাড়ির নিকোনো দাওয়ায় বড় বড় লোহার ট্রাঙ্ক নিয়ে
বসেছে শাঁখার ব্যাপারী। এই মেলা পুরোপুরি গ্রামীন গন্ধের। মেয়ে বউরা শাঁখা পরছে।
চোখের সামনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে নিচ্ছে কোথাও ফাটলের সূক্ষ্ম কোনো দাগ আছে কি না।
আরেকটু দূরে বসেছে পুজোর সামগ্রী। তার পিছনেই আড়ালে একটু উঁচুতে একসারি মাটির ঘর।
তার প্রত্যেকটির দাওয়ায় ঝুলছে নানা রঙের নানা মাপের শ্রীখোল। মূল রাস্তা থেকে এই
দোকান গুলো ততটা দৃশ্যমান না হলেও সন্ধানী লোকেরা ঠিক পৌঁছে যাচ্ছে এই খোলের
বাজারে। সাকুল্যে আট দশটি দোকান। কীর্তনীয়ারা এসে বাজিয়ে বাজিয়ে পরখ করে কিনে নিয়ে
যাচ্ছে পছন্দসই খোল। কারোর হাতের পাঞ্জা বড়, কারোর ছোট। সবার জন্য রয়েছে সব মাপের
খোল। একেবারে ছোট শিক্ষার্থীর জন্যও আছে কয়েকটা। দাম হাজার খানেক থেকে পাঁচ
ছ’হাজার পর্যন্ত। খোল বিক্রেতাদের অনুরোধে তাদের দাওয়ায় বসে কিছুক্ষণ দেখলাম
কেনাবেচা। ওঁরা এসেছেন পাশের দিনাজপুর থেকে, কেউ আরো উত্তরের। সামনে বর্ষার দু তিন
মাস হাতে কোনো কাজ থাকবে না। তার আগের এই মেলাই ওঁদের সম্বল। তবে মেলার বিক্রিবাটা
খুব ভাল। সামনে বসিয়ে রাখা আর ঝোলানো যাবতীয় খোল দেখিয়ে বললেন এই সবই বিক্রি হয়ে
যাবে এই চারদিনে। দাম অনু্যায়ী একেকটা খোলে হাজার বারোশো টাকা পর্যন্ত ছাড় দিয়ে দেন
ওঁরা। এত কমে কোথাও এ জিনিস পাওয়া যায়না। তাই বাদকেরা সবারই রামকেলির মেলা থেকে
খোল কেনার লক্ষ্য নিয়েই আসেন। একজন খোলের কারিগর বললেন যান এবার একটু স্নান করে
আসুন। এই রাস্তায় বারোদুয়ারীর দিকে যেতে ডান হাতে বাঁক নিলে আমবাগান, আর আমবাগানের
শেষে একটা নদী।
রাস্তায় বাঁক
নিয়েই পড়ল একটা আধশোয়া ঘূর্ণি আর একটা খাড়া নাগরদোলা। তার পাশেই স্বল্পবসনা যুবতীর
ছবি দেওয়া একটা তাঁবু। নাচের আসর বসবে সন্ধ্যায়। ২০০৮সালে প্রকাশিত ‘বাংলার মেলা’
বইতে গীতা পালিত সুপ্রিয় কর জানাচ্ছেন এই মেলায় তাঁরা নাগরদোলা দেখেন নি। এখন যদিও
হয়েছে একটি, তা হলেও এই মেলা চরিত্রগত ভাবে এখনো গ্রামীন আর যথেষ্টই স্বতন্ত্র।
ভরদুপুরে প্রকান্ড আমবাগানের মধ্যে শুধুই ছায়া। আমগাছ গুলো সবই বেঁটে বেঁটে।
প্রত্যেক মালিকের বাগানের সীমানা তারকাঁটায় ঘেরা। এরকম চার-পাঁচটি বাগান পেরিয়ে
নদী। হা-ক্লান্ত হয়ে যার ধারে দাঁড়ালাম তাকে নদী না বলে নালা বলাই শ্রেয়। জল
কচুরিপানায় ঢাকা, কালো আর মলিন। বৃদ্ধা দুজন মহিলা তাদের নাতি নিয়ে স্নান করতে
এসেছেন। সঙ্গে এক ঝুড়ি কাপড়। কাচতে কাচতে গল্প চলতে লাগল। একটু দূরে পাশের ঘাটের
এক স্নানার্থী জোর গলায় কারো মৃত্যু সংবাদ দিলেন। তাই নিয়ে এপারের ঘাটে্ দুই মহিলা
কিছু বিলাপ করলেন। স্নান করতে এল সুঠাম চেহারার কয়েকটি যুবক। তারা ওই নাচের দলের
তাঁবু থেকে আসছে। তাদের আলোচনার বিষয়ের কেন্দ্রে তাদেরই দলের একমাত্র মহিলা নৃত্যশিল্পী।
বোঝা গেল শুধু দর্শকেরাই নয় মেয়েটিকে নিয়ে তার সহশিল্পীদের মনেও সমান যৌনকৌতুহল।
আরো জানা গেল সেই নর্তকী স্নান করতে এই ঘাটেই আসেন, কিন্তু সঙ্গে থাকে কয়েকজন
প্রহরী। স্নানের সময়ে তাঁর অঙ্গমার্জনার জন্যও আছে আলাদা কর্মী। এরপর আলোচনা চলতে
লাগল নাচের অনুষ্ঠান চলাকালীন কিভাবে তারা মেয়েটির শরীরের স্পর্শ পেয়েছে সে নিয়ে। তটস্থ
হইয়া মনে বিচার যদি করি/সর্ব রস হইতে শৃঙ্গারে অধিক মাধুরী/অতএব মধুর রস কহি তার
নাম/স্বকীয়া পরকীয়া ভাব দ্বিবিধ সংস্থান।। একসময়ে এই মেলায় ‘কন্ঠীবদল’ প্রথা ছিল।
বৈষ্ণব পরিবারের বিবাহযোগ্যা মেয়েদের আনা হত মেলায়। তাঁদের সর্বশরীর ঢাকা থাকত
কাপড়ে আর সেই কাপড়ের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে থাকত বাম হাতের কড়ে আঙ্গুল (মতান্তরে অনামিকা)। মুখ নয়,
মুখশ্রী নয়, মরাল গ্রীবা নয়, রেশমকোমল চুল নয় পাণিপ্রার্থীদের কাছে পছন্দ করার মত
রইল শুধুমাত্র একটি কড়ে আঙ্গুল। নদীর ধারে গাছের ছায়ায় বসে আমার নিরাভরণ পাখাটি
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভাবি, মেয়েরা বসে আছেন, পুরুষেরা কেউ মেয়ের কড়ে আঙ্গুলটি দেখেই চলে
যাচ্ছে্ন অন্য নারীর কাছে, কেউ বা কন্ঠীবদল করে বিবাহ করে নিচ্ছে সেখানেই। বিয়ের
জন্যই ত তাদের আসা। আচ্ছা কড়ে আঙ্গুলই কেন? কেন তর্জনী বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ নয়? কারণ কি
এই যে, কড়ে আঙ্গু্লটি অন্যান্য আঙ্গুলের তুলনায় সাংসারিক ঝড় ঝাপ্টার প্রভাব থেকে
বেশ কিছুটা মুক্ত? তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে হয়ত গৃহকর্মের ভারী ছাপ, হয়ত সে আঙ্গুল দুটোয় বঁটিতে
কাটা ফাটলের মত দাগে মোচার কালো কষ লেগে তাদের মন ভোলানোর ক্ষমতা হারিয়ে গিয়েছে।
শ্রীচৈতন্যের অতি প্রিয় খাবার ছিল দুধে পাক করা গর্ভথোড়। গৃহত্যাগের রাতেও এই খাবারই তিনি খেয়েছিলেন। থোড় কাটলেও তো হাত
কালো হয়ে যায়, আচ্ছা, শ্চীর আঙ্গুলেও কি এইরকম বঁটির কালো দাগ ছিল? একজন লিখেছেন
শ্রীচৈতন্য চেয়েছিলেন সব জীবের উদ্ধার হোক, উঁচু নিচ জাতি, দরিদ্র ধন্ সমাজচ্যুত
সবাই কৃষ্ণনামে উদ্ধার পাক, এই প্রথাটা হয়ত তারই একটা সম্প্রসারিত রূপ। কড়ে
আঙ্গুলে সবাই সমান হওয়ার একটা সুযোগ পাচ্ছে। সত্যিই কি তাই। কড়ে আঙুল দেখে বিয়ে
করে নিয়ে যাওয়ার পরে দেখা গেল কনের দাঁত উঁচু মুখশ্রীও সুন্দর নয়, সে মেয়ের কদর
হতো তো শ্বশুরবাড়িতে? কোনো পরিসংখ্যান নেই তার। তার চেয়ে ভাল লাগল এক বৈষ্ণবী
তুলসীর মালা পরিয়ে দিচ্ছেন আরেকজনকে, দুজনের হাসি হাসি মুখ।
আবার মূল মেলার
রাস্তায় চলে এলাম। শীতলপাটি্র বিক্রি জমে উঠেছে। গোল করে গোটানো সারি দেওয়া প্রচুর
পাটির মধ্যে থেকে মনোমত পাটি বেছে নেওয়ার অঢেল সুযোগ। কারো পছন্দ দু রঙের নকশা করে
বোনা পাটি, কারো বা নিরলঙ্কৃত। দাম আট ন’শো। বারোদুয়ারির সামনে দিয়ে রাস্তা বেঁকে
গেছে ডানদিকে। সে রাস্তা যেমন যেমন চলেছে তেমন তেমন চললে আরেকটা সৌধের সামনে যাওয়া
যায়। এর নাম দাখিল দরওয়াজা। এই সৌধের নিচেই বসেছে গম্ভীরার আসর। গম্ভীরা শিবের
গীত। কিন্তু এখন এর জনপ্রিয়তা অন্য জায়গায়। যে সব গম্ভীরা এখন গাওয়া হয় তা শুনতে
অনেকটা কবির লড়াই এর মত। বিষয় একেবারেই সাম্প্রতিক কোনো ঘটনার বিশ্লেষণ। যেমন তখন
চলছিল কোলকাতায় ডাক্তারদের নিগ্রহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন। ডাক্তার নিগ্রহ
উচিত হয়েছে কি না আর ডাক্তারদেরই বা রোগীর অসুবিধা করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার
যৌক্তিকতা কতটা এই ঞ্ছিল সে আসরের গম্ভীরার বিষয়। এই নিয়ে গানে গানে কিছুটা
সামাজিক বিচারসভা চলল। অবশেষে সবাই মানুষের শুভবুদ্ধিতে আস্থা রেখে আসর ছেড়ে উঠে
পড়লেন। আসরে বসে সেই পাখার হাওয়া খেতে খেতে মনে হল রামকেলিই তো রাজনীতি চর্চার
উপযুক্ত জায়গা। শ্রীচৈতন্য এখানে আসার আগেই হোসেন শাহ ভাবছিলেন উৎকল আক্রমণ করবেন।
তাঁর দুই উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী অমর আর সন্তোষ সে রাতে শ্রীচৈতন্যের সঙ্গে দেখা
করার পর সব কিছু উলটে গেল। ছোট ভাই সন্তোষ (রূপ) রাজধানী ছেড়ে চলে গেলেন দেশের
বাড়ি আর বড় ভাই অমর যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করে বন্দী হলেন হোসেন শাহের কারাগারে। এক
চালে সুলতানের উৎকল আক্রমণের ছক ভেস্তে গেল। শক্তিহীন সুলতান এরপরেও যুদ্ধে
গেছিলেন তবে ততদিনে উৎকলরাজ প্রতাপরুদ্র নিজেকে গুছিয়ে নিতে অনেকটা সময় পেয়ে
গেছেন। আর সেই ছিল হোসেন শাহের শেষ উড়িষ্যা আক্রমণ।
বেলা গড়িয়ে এল। বিকেলের
আলো মরে এল। রাস্তা থেকে একটু দূরে প্লাস্টিক টাঙিয়ে বিক্রি হচ্ছে হাতে তৈরী
কম্বল। বড় ভাই অমর ততদিনে সনাতন। প্রয়াগে শ্রীচৈতন্যের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার আগে
তার ভগ্নিপতি সনাতনকে একটা মূল্যবান ভোট কম্বল দিয়েছিলেন। সন্ন্যাস নেওয়ার পর যখন
শ্রীচৈতন্যের কাছে ভিক্ষা করে আহার সংগ্রহের অনুমতি চাইছেন সনাতন তাঁর গায়ে তখনো
সেই দামি কম্বল। দেখলেন শ্রীচৈতন্য ওই কম্বলের দিকে বারবার দৃষ্টিপাত করছেন।
ব্যাপার বুঝে সনাতন সেটি এক দরিদ্রকে দিয়ে দিলেন। খুশি হয়ে শ্রীচৈতন্য বললেন দামি
জিনিস নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি মানায় না। তবে মেলার কম্বলের বিক্রেতাও কোণঠাসা। বাজারে
এসেছে চিনে কম্বল, যদিও এ মেলায় এখনো তাদের প্রবেশাধিকার নেই।
কেলিকদম্বের তলায় শ্রীচৈতন্যদয়েবের মূর্তি
প্রভাতী পরিক্রমায়
বাঘের সঙ্গে
বারোদুয়ারিতে কেনাবেচা
কীর্তনের আসরে
অলঙ্কৃত শিল
্ধামা নিয়ে
খোলের পসরা
শীতলপাটি
হাতে তৈরি কম্বলের বাজারে
সুন্দর প্রতিবেদন। ছবি আরও কথা বলছে।
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ। উৎসাহ পেলাম
মুছুনরামকেলি মেলার সর্বদিকদর্শী সর্বাঙ্গসুন্দর একটি উপভোগ্য রমণীয় রচনা ৷ সহচর আলোকচিত্রগুলিও বর্ণনাকে জীবন্ত করতে যেন বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে ৷ যথার্থ দ্রষ্টা লেখককে অভিনন্দন ৷
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ আপনাকেও
মুছুনParer lekhar janno apekkha.
উত্তরমুছুননিশ্চই হবে
মুছুনঅত্যন্ত উচ্চমানের রচনা
উত্তরমুছুন